কাজী নজরুল ইসলাম-এর কবিতা
Friday, May 18, 2018, 5:32 AM
॥ ১॥
বন্ধন
Friday, May 18, 2018, 3:08 AM
অনন্তকাল এ-অনন্তলোকে
মন-ভোলানোরে তার খুঁজে ফিরে মন।
দক্ষিণা-বায় চায় ফুল-কোরকে ;
পাখি চায় শাখী, লতা-পাতা-ঘেরা বন।
বিশ্বের কামনা এ – এক হবে দুই ;
নূতনে নূতনতর দেখিবে নিতুই॥
তোমারে গাওয়াত গান যার বিরহ
এড়িয়ে চলার ছলে যাচিয়াছ যায়,
এল সেই সুদূরের মদির-মোহ
এল সেই বন্ধন জড়াতে গলায়।
মালা যে পরিতে জানে, কন্ঠে তাহার
হয় না গলার ফাঁসি চারু-ফুলহার॥
জলময়, নদী তবু নহে জলাশয়,
কূলে কূলে বন্ধন তবু গাহে গান ;
বুকে তরণির বোঝা কিছু যেন নয়–
সিন্ধুর সন্ধানী চঞ্চল-প্রাণ।
দুই পাশে থাক তব বন্ধন-পাশ,
সমুখে জাগিয়া থাক সাগর-বিলাস॥
বিরহের চখাচখি রচে তারা নীড়,
প্রাতে শোনে নির্মল বিমানের ডাক ;
সেই ডাকে ভোলে নীড়, ভোলে নদীতীর,
সন্ধ্যায় গাহে : ‘এই বন্ধন থাক’!
আকাশের তারা থাক কল্পলোকে,
মাটির প্রদীপ থাক জাগর-চোখে॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
ঘোষণা
Friday, May 18, 2018, 10:25 AM
হাতে হাত দিয়ে আগে চলো, হাতে
নাই থাক হাতিয়ার!
জমায়েত হও, আপনি আসিবে
শক্তি জুলফিকার॥
আনো আলির শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,
ওমরের মতো কর্মানুরাগ,
খালেদের মতো সব অসাম্য
ভেঙে করো একাকার॥
ইসলামে নাই ছোটো বড়ো আর
আশরাফ আতরাফ;
এই ভেদ-জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে
করো মিসমার সাফ!
চাকর সৃজিতে চাকরি করিতে
ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে;
মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,
কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন,
এ-জুলুম সহেনিকো ইসলাম –
সহিবে না আজও আর॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
গান
Friday, May 18, 2018, 11:28 AM
আমার বিফল পূজাঞ্জলি
অশ্রু-স্রোতে যায় যে ভেসে।
তোমার আরাধিকার পূজা
হে বিরহী, লও হে এসে।
খোঁজে তোমায় চন্দ্র তপন,
পূজে তোমায় বিশ্বভুবন,
আমার যে নাথ ক্ষণিক জীবন
মিটবে কি সাধ ভালোবেসে॥
না-দেখা মোর বন্ধু ওগো,
কোথায় বাঁশি বাজাও একা,
প্রাণ বোঝে তা অনুভবে
নয়ন কেন পায় না দেখা!
সিন্ধু যেমন বিপুল টানে
তটিনীরে টেনে আনে,
তেমনি করে তোমার পানে
আমায় ডাকো নিরুদ্দেশে॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
কর্থ্যভাষা
Thursday, May 17, 2018, 8:44 PM
কর্থ্যভাষা কইতে নারি শুর্দ্ধ কথা ভিন্ন।
নেড়ায় আমি নিম্ন বলি (কারণ) ছেঁড়ায় বলি ছিন্ন॥
গোঁসাইকে কই গোস্বামী, তাই মশাইকে মোর্স্বামী।
বানকে বলি বন্যা, আর কানকে কন্যা কই আমি॥
চাষায় আমি চশ্শ বলি, আশায় বলি অশ্ব।
কোটকে বলি কোষ্ঠ, আর নাসায় বলি নস্য॥
শশারে কই শিষ্য আমি, ভাষারে কই ভীষ্ম।
পিসিরে কই পিষ্টক আর মাসিরে মাহিষ্য॥
পুকুরকে কই প্রুষ্করিণী, কুকুরকে কই ক্রুক্কু।
বদনকে কই বদনা, আর গাড়ুকে গুড়ুক্কু॥
চাঁড়ালকে কই চণ্ডাল, তাই আড়ালকে অণ্ডাল।
শালারে কই শলাকা, আর কালায় বলি কঙ্কাল॥
শ্বশুরকে কই শ্মশ্রু, আর দাদাকে কই দদ্রু।
বামারে কই বম্বু, আর কাদারে কই কদ্রু॥
আরও অনেক বাত্রা জানি, বুঝলে ভায়া মিন্টু।
ভেবেছ সব শিখে নেবে, বলছিনে আর কিন্তু॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
উঠিয়াছে ঝড়
Friday, May 18, 2018, 10:37 AM
উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিছে তার,
ওরে ভীরু, ওঠ, এখনই টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার!
কৃষ্ণ মেঘের নিশান তাহার দোলে পশ্চিম-তোরণে ওই,
ভ্রুকুটি- ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে নাচে নদনদী তাথই থই।
তরবারি তার হানিছে ঝিলিক সর্পিল বিদ্যুল্লেখায়,
হানিবে আঘাত তোর স্বপ্নের শিশমহলের দরোয়াজায় ;
কাঁদিবে পূর্ব পুবালি হাওয়ায়, ফোটাবে কদম জুঁই কুসুম ;
বৃষ্টিধারায় ঝরিবে অশ্রু, ঘনালে প্রলয় রবে নিঝুম?
যে দেশে সূর্য ডোবে – সেই দেশে হইল নবীন সূর্যোদয়,
উদয়-অচলে টলমল করে অস্ত-রবির আঁধার ভয়!
যুগ যুগ ধরি, তপস্যা দিয়ে করেছি মহিরে মহামহান,
ফুটায়েছি ফুল কর্ষিয়া মরু, ধূলির ঊর্ধ্বে গেয়েছি গান।
আজি সেই ফুলে-ফসল-মেলায় অধিকার নাই আমাদেরই,
আমাদের ধ্যান-সুন্দর ধরা আমাদের নয় আজি হেরি!
গীত-শেষে নীড়ে ফিরিবার বেলা হেরি নীড়ে বাসা বাঁধে শকুন,
মাংস-লোলুপ ফিরিতেছে ব্যাধ স্কন্ধে রক্ত-ধনুর্গুণ!
নীড়ে ফিরিবার পথ নাই তোর, নিম্নে নিষাদ, ঊর্ধ্বে বাজ,
তোর সে অতীত মহিমা আজিকে তোরে সব চেয়ে হানিছে লাজ!
উঠিয়াছে ঝড় – ঝড় উঠিয়াছে প্রলয়-রণের আমন্ত্রণ,
‘আদাওতি’র এ দাওতে কে যাবি মৃত্যুতে প্রাণ করিয়া পণ?
ঝড়ে যা উড়িবে, পুড়িবে আগুনে, উড়ুক পুড়ুক সে সম্বল,
মৃত্যু যেখানে ধ্রুব তোর সেথা মৃত্যুরে হেসে বরিবি চল!
অপরিমাণ এ জীবনে করিবি জীবিতের মতো ব্যয় যদি,
ঊর্ধ্বে থাকুক ঝড়ের আশিস, চরণে মরণ-অম্বুধি!
বিধাতার দান এই পবিত্র দেহের করিবি অসম্মান?
শকুন-শিবার খাদ্য হইবি, ফিরায়ে দিবি না খোদার দান?
এ-জীবন ফুল-অঞ্জলি সম নজরানা দিবি মৃত্যুরে, –
জীবিতের মতো ভুঞ্জি জীবন ব্যয় করে যা তা প্রাণ পুরে!
চরণে দলেছি বিপুলা পৃথ্বী কোটি গ্রহ তারা ধরি শিরে,
মোদের তীর্থ লাগি রবি শশী নিশিদিন আসে ফিরে ফিরে।
নিঃসীম নভ ছত্র ধরিয়া, বন্দনা-গান গাহে বিহগ,
বর্ষায় ঝরে রহমত-পানি-প্রতীক্ষমাণ সাত স্বরগ।
অপরিমাণ এ দানেরে কেমনে করিবি, রে ভীরু অস্বীকার?
মৃত্যুর মারফতে শোধ দিব বিধির এ মহাদানের ধার।
রোগ-পাণ্ডুর দেহ নয় – দিব সুন্দর তনু কোরবানি,
রোগ ও জরারে দিব না এ দেহ, জীবন-ফুলের ফুলদানি।
তাজা এ স্বাস্থ্য সুন্দর দেহ মৃত্যুরে দিবি অর্ঘ্যদান,
অতিথিরে দিবি কীটে-খাওয়া ফুল? লতা ছিঁড়ে তাজা কুসুম আন!
আসিয়াছে ঝড়, ঘরের ভিতর তাজিম করিয়া অতিথে ডাক,
বন্ধুর পথে এসেছে বন্ধু, হাসিয়া দস্তে দস্ত রাখ।
যৌবন-মদ পূর্ণ করিয়া জীবনের মৃৎপাত্র ভর,
তাই নিয়ে সব বেহুঁশ হইয়া ঝঞ্ঝার সাথে পাঞ্জা ধর।
ঝঞ্ঝার বেগ রুধিতে নারিবে পড়-পড় ওই গৃহ রে তোর,
খুঁটি ধরে তার কেন বৃথা আর থাকিস বসিয়া, ভাঙ এ দোর!
রবির চুল্লি নিভিয়া গিয়াছে, ধূম্রায়মান নীল গগন,
ঝঞ্ঝা এসেছে ঝাপটিয়া পাখা, ধেয়ে আয় তুই ক্ষীণ পবন!
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
আগা মুরগি লে কে ভাগা
Friday, May 18, 2018, 10:59 AM
[সুর : ‘একদা তুমি প্রিয়ে আমারই এ তরুমূলে’]
একদা তুমি আগা দৌড়ে কে ভাগা মুরগি লেকে।
তোমারে ফেলনু চিনে ওই আননে জমকালো চাপ দাড়ি দেখে॥
কালো জাম খাচ্ছিলে যে সেইদিন সেই গাছে চড়ে
কালো জাম মনে করে ফেললে খেয়ে ভোমরা ধরে।
‘চুঁ করো আওর চাঁ করো ছোড়ে গা নেই,
সব কুছ কালা কালা খা জায়ে গা’ – বললে হেঁকে॥
ভুলো আর টেমি জিমি চেনে যে ওই ঝাঁকড় চুলে,
তোমারে দেখলে পরে তারস্বরে আসে তেড়ে ল্যাজুড় তুলে।
ও-পাড়ার হীরু তোমায় দেখেই পালায় পগার-পারে,
‘রুপিয়া লে আও,’ বলে ধরলে তাহার ছাগলটারে।
দেখিয়াই মটরু মিয়াঁর মুরগি লুকায় ঝোপের আড়ে,
তাই কি ছেলেমেয়ে মুরগি-চোরা বলে ডাকে॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
আঁধারে
Friday, May 18, 2018, 5:30 AM
অমানিশায় আসে আঁধার তেপান্তরের মাঠে;
স্তব্ধ ভয়ে পথিক ভাবে,– কেমনে রাত কাটে!
ওই যে ডাকে হুতোম-পেঁচা, বাতাস করে শাঁ শাঁ!
মেঘে ঢাকা অচিন মুলুক; কোথায় রে কার বাসা?
গা ছুঁয়ে যায় কালিয়ে শীতে শূন্য পথের জু জু–
আঁধার ঘোরে জীবন-খেলার নূতন পালা রুজু।
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
অপরূপ সে দুরন্ত
Friday, May 18, 2018, 2:03 AM
ভাব-বিলাসী অপরূপ সে দুরন্ত,
বাঁধন-হারা মন সদা তার উড়ন্ত!
সে ঘুরে বেড়ায় নীল আকাশে।
চাঁদের সাথে মুচকি হাসে,
গুঞ্জরে সে মউ-মক্ষীর গুঞ্জনে,
সে ফুলের সাথে ফোটে, ঝরে পরাগ হয়ে অঙ্গনে।
তার চোখের পলক ভোরের তারায় ঝলে,
ধুমকেতু তার ফুলঝুরি, সে উল্কা হয়ে চলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।
সে প্রথম-ফোটা গোলাপ-কুঁড়ির সনে–
হিঙুল হয়ে ওঠে লাজে হঠাৎ অকারণে।
ধরা তারে ধরতে নারে ঘরের প্রদীপ দিয়ে,
সে শিশির হয়ে কাঁদে, খেলে পাখির পালক নিয়ে।
সে ঝড়ের সাথে হাসে
সে সাগর-স্রোতে ভাসে,
সে উদাস মনে বসে থাকে জংলা পথের পাশে
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
সে বৃষ্টিধারার সাথে পড়ে গলে,
অস্ত-রবির আড়াল টেনে লুকায় গগন-তলে।
দীপ্ত রবির মুকুরে সে আপন ছায়া দেখে,
সে পথে যেতে যায় যেন কি মায়ার মোহ এঁকে।
ঝরা তারার তির হানে সে নিশুত রাতের নভে,
ঘুমন্তরে জাগিয়ে সে দেয় বিপুল বজ্র-রবে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
সে রঙিন প্রজাপতি
কভু ফুলের দিকে মতি
কভু ভুলের দিকে গতি
তার রুধির-ধারা নদীর স্রোতের মতো
দেহের কূলে বদ্ধ তবু মুক্ত অবিরত।
রূপকে বলে সঙ্গিনী সে, প্রেমকে বলে প্রিয়া,
রূপ ঘুমালে ঊর্ধ্বে ওঠে আত্মাতে প্রেম নিয়া।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।
মরণকে সে ভয় করে না, জ্ঞানীর সভায় ভয়,–
ভাবের সাথে ভাব করে সে অভাব করে জয়।
তার তরল হাসি সরল ভাবে মুগ্ধ সবার মন,
মন ভরে না জ্ঞানীর, করে অর্থ অন্বেষণ।
চোখ আছে যার, তারই চোখের পাতা টিপে ধরে,
হাতিশালায় যায় না, যায় ফুল ফোটে যে-ঘরে।
তার পথের পথিক সাথি,
তার বন্ধু নীরব রাতি,
খ্যাতির খাতায় চায় না চাঁদা, চাঁদের সাথে খেলে,
সে কথা কহে, মুক্ত-পাখা পাখির দেখা পেলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
তারে জ্ঞান-বিলাসী ডাকে না, তায় গাঁয়ের চাষি ডাকে,
তৃষার জলের পাত্র-সম জড়িয়ে ধরে তাকে।
সে রয় না আন্দোলনে,
যেথা আনন্দ হয় আন্দোলিত যায় সে গোপন বনে।
সে চাঁদের আলো, বর্ষা-মেঘের জল,
আপনার খুশিতে ঝরে আপনি সে চঞ্চল।
সে চায় না ফুলের মালা, সে ফুলের মধু চায়,
সে চায় না তাহার নাম,
দান দিয়ে সে পালিয়ে বেড়ায়
চায় না তাহার দাম।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
কেউ যদি তায় ভালো বলে, আলোর বুকে হয় সে লয়,
বলে, ‘ওগো সুন্দর মোর, তোমায় বলে, আমায় নয়!’
ছন্দ তাহার স্বচ্ছন্দ, দ্বন্দ্ব মাঝে রয় না সে,
যে বড়ো তাঁর সুনাম নিয়ে ক্ষুদ্র কথা কয় না সে।
তার মন্দ শোনার নাইকো সময়,
রসের সাথে নিত্য প্রলয়,
তারে নিন্দা দিলে চন্দন দেয়
সে নন্দন-জাদুকর,
সুন্দর সে, তাই দেখে না কাহারেও সে অসুন্দর।
তারে লোভ দেখিয়ে যায় না ধরা,
আপনাকে যে দিতে চায়–
প্রেম-ভিক্ষু দুরন্ত সে লুটিয়ে পড়ে তাহার পায়।
পূর্ণের সে প্রতিচ্ছায়া, অপরূপ সে দুরন্ত,
মন কাঁদে মোর তারই তরে, মন সদা যার উড়ন্ত!
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন
---------------------------------------------
পিলে-পটকা
Thursday, May 17, 2018, 6:58 PM
উটমুখো সে সুঁটকো হাশিম,
পেট যেন ঠিক ভুঁটকো কাছিম!
চুলগুলো সব বাবুই দড়ি –
ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি!
তিন-কোনা ইয়া মস্ত মাথা,
ফ্যাচকা-চোখো; হস্ত? হাঁ তা
ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা!
নিটপিটে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা!
গাইতি-দেঁতো, উঁচকে কপাল
আঁতকে ওঠেন পুঁচকে গোপাল!
নাক খাঁদা ঠিক চামচিকেটি!
আর হাসি? দাঁত খামচি সেটি!
পাঁচের মতন থুতনো ব্যাঁকা!
রগঢিলে, হুঁ ভূতনো ন্যাকা!
কান দুটো টান – ঠিক সে কুলো!
তোবড়ানো গাল, টিকটা ছুলো!
বগলা প্রমাণ ঘাড়টি সরু,
চেঁচান যেন ষাঁড় কী গোরু!
চলেন গিজাং উরর কোলা ব্যাং,
তালপাতা তাঁর ক্ষুর-ওলা ঠ্যাং!
বদরাগি তায় এক-খেয়ালি
বাস রে! খেঁকি খ্যাঁক-শেয়ালি!
ফ্যাঁচকা-মাতু, ছিঁচকাঁদুনে,
কয় লোকে তাই মিচকা টুনে!
জগন্নাথী ঠুঁটো নুলো,
লোম গায়ে ঠিক খুঁটোগুলো!
ল্যাবেন্ডিসি নড়বড়ে চাল,
তুবড়ি মুখে চড়বড়ে গাল!
গুজুর-ঘুণে, দেড়-পাঁজুরে,
ল্যাডাগ্যাপচার, ন্যাড়-নেজুড়ে!
বসেন সে হাড়-ভাঙা ‘দ’,
চেহারা দেখেই সব মামা ‘থ’!
গিরগিটে তার ক্যাঁকলেসে ঢং
দেখলে কবে, ‘ধেত, এ যে সং!’
খ্যাঙরা-কাটি আঙলাগুলো,
কুঁদিলে শ্রীমুখ বাংলা চুলো!
পেটফুলো ইয়া মস্ত পিলে,
দৈবাতে তায় হস্ত দিলে
জোর চটিতং, বিটকেলে চাঁই!
ইঁট খাবে নাকো সিঁটকেলে ভাই!
নাক বেয়ে তার ঝরচে সিয়ান,
ময়রা যেমন করছে ভিয়ান!
স্বপন দেখেন হালকা নিঁদে –
কুইনাইন আর কালকাসিঁদে!
বদন সদাই তোলো হাঁড়ি,
গুড়ামুড়ি খান ষোলো আড়ি!
ঠোকরে সবাই ন্যাড়া মাথায় –
শিলাবিষ্টি ছেঁড়া ছাতায়!
রাক্ষুসে ভাত গিলতে পারে
বাপ রে, বিড়াল ডিঙতে নারে!
হন না ভুলেও ঘরের বাহির,
কাঁথার ভিতর জ্বরের জাহির!
পড়বে কি আর, দূর ভূত ছাই,
ওষুধ খেতেই ফুরসত নাই!
বুঝলে? যত মোটকা মিলে
বাগাও দেখি পটকা পিলে!
বাজবে পেটে তাল ভটাভট
নাক ধিনাধিন গাল ফটাফট!
ঢাকডুবাডুব ইড়িং-বিড়িং
নাচবে ফড়িং তিড়িং তিড়িং!
চুপসো গালে গাব গুবাগুব
গুপি-যন্তর বাজবে বাঃ খুব!
দিব্যি বসে মারবে মাছি,
কাশবে এবং হাঁচবে হাঁচি!
কিলবিলিয়ে দুটো ঠ্যাং
নড়বে যেমন ঠুঁটো ব্যাং!!
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
দিদির বে-তে খোকা
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
‘সাত ভাই চম্পা জাগো’ –
পারুলদি ডাকল, না গো?
একী ভাই, কাঁদচ? – মা গো
কী যে কয় – আরে দুত্তুর!
পারায়ে সপ্ত-সাগর
এসেছে সেই চেনা-বর?
কাহিনির দেশেতে ঘর
তোর সেই রাজপুত্তুর?
মনে হয়, মণ্ডা মেঠাই
খেয়ে জোর আয়েশ মিটাই! –
ভালো ছাই লগাছে না ভাই,
যাবি তুই একেলাটি!
দিদি, তুই সেথায় গিয়ে
যদি ভাই যাস ঘুমিয়ে,
জাগাব পরশ দিয়ে
রেখে যাস সোনার কাঠি।
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
ঠ্যাং-ফুলি
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
হো-হো-হো উররো হো-হো!
হো-হো-হো উররো হো-হো
উররো হো-হো
বাস কী মজা!
কে শুয়ে চুপ সে ভুঁয়ে,
নারছে হাতে পাশ কী সোজা!
হো-বাবা! ঠ্যাং ফুলো যে!
হাসে জোর ব্যাংগুলো সে
ড্যাং তুলো তার
ঠ্যাংটি দেখে!
ন্যাং ন্যাং য়্যাগগোদা ঠ্যাং
আঁতকে ওঠায় ডানপিটেকে!
এক ঠ্যাং তালপাতা তার
যেন বাঁট হালকা ছাতার!
আর পাটা তার
ভিটরে ডাগর!
যেন বাপ! গোবদা গো-সাপ
পেট-ফুলো হুস এক অজাগর!
মোদোটার পিসশাশুড়ি
গোদ-ঠ্যাং চিপসে বুড়ি
বিশ্ব জুড়ি
খিসসা যাহার!
ঠে-ঠে ঠ্যাং নাক ডেঙা ডেং
এই মেয়ে কি শিষ্যা তাহার?
হাদে দেখ আসছে তেড়ে
গোদা-ঠ্যাং ছাঁতসে নেড়ে,
হাসছে বেড়ে
বউদি দেখে!
অ ফুলি! তুই যে শুলি
দ্যাখ না গিয়ে চৌদিকে কে!
বটু তুই জোর দে ভোঁ দৌড়,
রাখালে! ভাঙবে গোঁ তোর
নাদনা গুঁতোর
ভিটিম ভাটিম!
ধুমাধুম তাল ধুমাধুম
পৃষ্ঠে, - মাথায় চাটিম চাটিম!
‘ইতু’ মুখ ভ্যাংচে বলে –
গোদা ঠ্যাং ন্যাংচে চলে
ব্যাং ছা যেন
ইড়িং বিড়িং!
রাগে ওর ঠ্যাং নড়ে জোর
য়্যাদ্দেখেছিস – তিড়িং তিড়িং!
মলিনা! অ খুকুনি!
মা গো! কী ধুকপুকুনি
হাড়-শুগুনি
ভয়-তরাসে!
দেখে ইস ভয়েই মরিস
ন্যাংনুলোটার পাঁইতারাকে।
গোদা-ঠ্যাং পুঁচকে মেয়ে
আসে জোর উঁচকে ধেয়ে
কুঁচকে কপাল,
ইস কী রগড়!
লেলিয়ে দে ঢেলিয়ে!
ফোঁস করে ফের! বিষ কী জবর!
ইন্দু! দৌড়ে যা না!
হাসি, তুই বগ দেখা না!
দগ্ধে না!
তোল তাতিয়ে!
রেণু! বাস, রেগেই ঠ্যাঙাস,
বউদি আসুন বোলতা নিয়ে!
আর না খাপচি খেলো!
ওলো এ আচ্ছি যে লো,
নাচছি তো খুব
ঠ্যাং নিয়ে ওর!
ব্যাচারির হ্যাঁস-ফ্যাসানির
শেষ নেই, মুখ ভ্যাংচিয়ে জোর!
ধ্যাত! পা পিছলে যে সে
পড়ে তার বিষ লেগেছে
ইস! পেকেছে
বিষ-ফোঁড়া এক!
সে ব্যথায় ঠ্যাং ফুলে তাই
ঢাক হল পা-র পিঠ জোড়া দেখ!
আচ্ছু! সত্যি সে শোন
কারুর এক রত্তি সে বোন,
দোষ নেই এতে
দোষ নিয়ো না!
আগে তোর ঠ্যাং ফুলে জোর,
তারপরে না দস্যিপনা!
আয় ভাই আর না আড়ি,
ভাব কর কান্না ছাড়ি,
ঘাড় না নাড়ি,
কসনে ‘উহুঁ’!
লক্ষ্মী! ধ্যাত, শোক কী?
ছিঁচ-কাঁদুনে হসনে হুঁ হুঁ!
উষাদের ঘর যাবিনে?
লাগে তোর লজ্জা দিনে?
বজ্জাতি নে
রাখ তুলে লো!
কেন? ঠ্যাং তেড়েং বেড়েং?
হাসবে লোকে? বয়েই গেল!
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
চিঠি
Thursday, May 17, 2018, 10:13 PM
[ছন্দ :- “এই পথটা কা-টবো
পাথর ফেলে মা-রবো”]
ছোট্ট বোনটি লক্ষ্মী
ভো ‘জটায়ু পক্ষী’!
য়্যাব্বড়ো তিন ছত্র
পেয়েছি তোর পত্র।
দিইনি চিঠি আগে,
তাইতে কি বোন রাগে?
হচ্ছে যে তোর কষ্ট
বুঝতেছি খুব পষ্ট।
তাইতে সদ্য সদ্য
লিখতেছি এই পদ্য।
দেখলি কী তোর ভাগ্যি!
থামবে এবার রাগ কি?
এবার হতে দিব্যি
এমনি করে লিখবি!
বুঝলি কী রে দুষ্টু
কী যে হলুম তুষ্টু
পেয়ে তোর ওই পত্র –
যদিও তিন ছত্র!
যদিও তোর অক্ষর
হাত পা যেন যক্ষর,
পেটটা কারুর চিপসে,
পিঠটে কারুর ঢিপসে,
ঠ্যাংটা কারুর লম্বা,
কেউ বা দেখতে রম্ভা!
কেউ যেন ঠিক থাম্বা,
কেউ বা ডাকেন হাম্বা!
থুতনো কারুর উচ্চে,
কেউ বা ঝুলেন পুচ্ছে!
এক একটা যা বানান
হাঁ করে কী জানান!
কারুর গা ঠিক উচ্ছের,
লিখলি এমনি গুচ্ছের!
না বোন, লক্ষ্মী, বুঝছ?
করব না আর কুচ্ছো!
নইলে দিয়ে লম্ফ
আনবি ভূমিকম্প!
কে বলে যে তুচ্ছ!
ওই যে আঙুর গুচ্ছ!
শিখিয়ে দিল কোন্ ঝি
নামটি যে তোর জন্টি?
লিখবে এবার লক্ষ্মী
নাম ‘জটায়ু পক্ষী!’
শিগগির আমি যাচ্চি,
তুই বুলি আর আচ্ছি
রাখবি শিখে সব গান
নয় ঠেঙিয়ে – অজ্ঞান!
এখনও কি আচ্ছু
খাচ্ছে জ্বরে খাপচু?
ভাঙেনি বউদির ঠ্যাংটা।
রাখালু কি ন্যাংটা?
বলিস তাকে, রাখালী!
সুখে রাখুন মা কালী!
বৌদিরে কোস দোত্তি
ধরবে এবার সত্যি।
গপাস করে গিলবে
য়্যাব্বড়ো দাঁত হিলবে!
মা মাসিমায় পেন্নাম
এখান হতেই করলাম!
স্নেহাশিস এক বস্তা,
পাঠাই, তোরা লস তা!
সাঙ্গ পদ্য সবিটা?
ইতি। তোদের কবি-দা।
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
খোকার বুদ্ধি
Thursday, May 17, 2018, 7:19 PM
চুন করে মুখ প্রাচীর পরে বসে শ্রীযুত খোকা,
কেননা তার মা বলেছেন সে এক নিরেট বোকা।
ডানপিটে সে খোকা এখন মস্ত একটা বীর,
হুংকারে তাঁর হাঁস মুরগির ছানার চক্ষুস্থির!
সাত লাঠিতে ফড়িং মারেন এমনই পালোয়ান!
দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লে সেদিন আস্ত আলোয়ান!
ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা,
তাঁরে কিনা বোকা বলা? কী এর উচিত সাজা?
ভাবতে ভাবতে খোকার হঠাৎ চিন্তা গেল থেমে,
দে দৌড় চোঁ-চাঁ আঁধমহলে পাঁচিল হতে নেমে!
বুকের ভেতর ছপাই নপাই ধুকপুকুনির চোটে,
বাইরে কিন্তু চতুর খোকা ঘাবড়ালেন না মোটে।
হাঁপিয়ে এসে মায়ের কাছে বললে, “ওগো মা!
আমি নাকি বোক-চন্দর? বুদ্ধি দেখে যা!
ওই না একটা মটকু বানর দিব্যি মাচায় বসে
লাউ খাচ্ছে? কেউ দেখেনি, দেখি আমিই তো সে।
দিদিদেরও চোখ ছিল তো, কেউ কি দেখেছেন?
তবে আমায় বোকা কও যে! এ্যাঁ-এ্যাঁ, হাস ক্যান্?
কী কও? ‘একী বুদ্ধি হল?’ দেখবে তবে? হাঁ,
বুদ্ধি আমার … ভোলা! তু-উ-উ! লৌ-হা হা-হা-হা!”
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
খোকার গপ্প বলা
Thursday, May 17, 2018, 6:03 PM
মা ডেকে কন, ‘খোকন-মণি! গপ্প তুমি জানো?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বললে খোকন, ‘গপপ জানি, জানি আমি গানও!’
বলেই খুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল –
‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’
মা সে হেসে তখন
বলেন, ‘উহুঁ, গান না, তুমি গপ্প বলো খোকন!’
ন্যাংটা শ্রীযুত খোকা তখন জোর গম্ভীর চালে
সটান কেদারাতে শুয়ে বলেন, “সত্যিকালে
এক যে ছিল রাজা আর মা এক যে ছিল রানি,
হাঁ মা আমি জানি,
মায়ে পোয়ে থাকত তারা,
ঠিক যেন ওই গোঁদলপাড়ার জুজুবুড়ির পারা!
একদিন না রাজা –
ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড়ভাজা!
রানি গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক!
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে
হাতির মতন একটা বেড়াল-বাচ্চা শিকার করে।
এসে রাজা দেখেন কিনা বাপ!
রাজবাড়িতে আগড় দেওয়া, রানি কোথায় গাপ!
দুটোয় গিয়ে এলেন রাজা সতরোটার সে সময়!
বলো তো মা-মণি তুমি, খিদে কি তায় কম হয়?
টাটি-দেওয়া রাজবাড়িতে ওগো,
পান্তাভাত কে বেড়ে দেবে?
খিদের জ্বালায় ভোগো!
ভুলুর মতন দাঁত খিঁচিয়ে বলেন তখন রাজা,
নাদনা দিয়ে জরুর রানির ভাঙা চাই-ই মাজা।
এমন সময় দেখেন রাজা আসচে রানি দৌড়ে
সারকুঁড় হতে ক্যাঁকড়া ধরে রাম-ছাগলে চড়ে!
দেখেই রাজা দাদার মতন খিচমিচিয়ে উঠে –”
‘হাঁরে পুঁটে!’
বলেই খোকার শ্রীযুত দাদা সটান
দুইটি কানে ধরে খোকার চড় কসালেন পটাম্।
বলেন, ‘হাঁদা! ক্যাবলাকান্ত! চাষাড়ে।
গপ্প করতে ঠাঁই পাওনি চণ্ডুখুড়ি আষাঢ়ে?
দেব নাকি ঠ্যাংটা ধরে আছাড়ে?
কাঁদেন আবার! মারব এমন থাপড়,
যে কেঁদে তোমার পেটটি হবে কামার শালার হাপর!’
চড় চাপড় আর কিলে,
ভ্যাবাচ্যাকা খোকামণির চমকে গেল পিলে!
সেদিনকারের গপ্প বলার হয়ে গেল রফা,
খানিক কিন্তু ভেড়ার ভ্যাঁ ডাক শুনেছিলুম তোফা!
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
------------------------------
খোকার খুশি
Thursday, May 17, 2018, 6:03 PM
কী যে ছাই ধানাই-পানাই –
সারাদিন বাজছে সানাই,
এদিকে কারুর গা নাই
আজই না মামার বিয়ে!
বিবাহ! বাস, কী মজা!
সারাদিন মণ্ডা গজা
গপাগপ খাও না সোজা
দেয়ালে ঠেসান দিয়ে।
তবু বর হচ্ছিনে ভাই,
বরের কী মুশকিলটাই –
সারাদিন উপোস মশাই
শুধু খাও হরিমটর!
শোনো ভাই, মোদের যবে
বিবাহ করতে হবে –
‘বিয়ে দাও’ বলব, ‘তবে
কিছুতেই হচ্ছিনে বর!’
সত্যি, কও না মামা,
আমাদের অমনি জামা
অমনি মাথায় ধামা
দেবে না বিয়ে দিয়ে?
মামিমা আসলে এ ঘর
মোদেরও করবে আদর?
বাস, কী মজার খবর!
আমি রোজ করব বিয়ে॥
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
অর্ঘ্য
Friday, May 18, 2018, 10:59 AM
হায় চির-ভোলা! হিমালয় হতে
অমৃত আনিতে গিয়া
ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের
মৃত্যু-গরল পিয়া!
কেন এত ভালো বেসেছিলে তুমি
এই ধরণির ধূলি?
দেবতারা তাই দামামা বাজায়ে
স্বর্গে লইল তুলি!
হুগলি
৩রা আষাঢ়, ১৩৩২
(চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ)
অকাল-সন্ধ্যা
Friday, May 18, 2018, 1:40 AM
অকাল-সন্ধ্যা
[জয়জয়ন্তী কীর্তন]
খোলো মা দুয়ার খোলো
প্রভাতেই সন্ধ্যা হল
দুপুরেই ডুবল দিবাকর গো।
সমরে শয়ান ওই
সুত তোর বিশ্বজয়ী
কাঁদনের উঠছে তুফান ঝড় গো॥
সবারে বিলিয়ে সুধা,
সে নিল মৃত্যু-ক্ষুধা,
কুসুম ফেলে নিল খঞ্জর গো।
তাহারই অস্থি চিরে
দেবতা বজ্র গড়ে
নাশে ওই অসুর অসুন্দর গো।
ওই মা যায় সে হেসে।
দেবতার উপরে সে,
ধরা নয়, স্বর্গ তাহার ঘর গো॥
যাও বীর যাও গো চলে
চরণে মরণ দলে
করুক প্রণাম বিশ্ব-চরাচর গো।
তোমার ওই চিত্ত জ্বেলে
ভাঙ্গালে ঘুম ভাঙ্গালে
নিজে হায় নিবলে চিতার পর গো।
বেদনার শ্মশান-দহে
পুড়ালে আপন দেহে,
হেথা কি নাচবে না শংকর গো॥
আরিয়াদহ
৬ আষাঢ়, ১৩৩২
(চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ)
সুবহ্-উম্মেদ
Thursday, May 17, 2018, 11:49 PM
সর্বনাশের পরে পৌষ মাস
এল কি আবার ইসলামের?
মন্বন্তর-অন্তে কে দিল
ধরণিরে ধন-ধান্য ঢের?
ভুখারির রোজা রমজান পরে
এল কি ঈদের নওরোজা?
এল কি আরব-আহবে আবার
মূর্ত মর্ত-মোর্তজা?
হিজরত করে হজরত কি রে
এল এ মেদিনী-মদিনা ফের?
নতুন করিয়া হিজরি গণনা
হবে কি আবার মুসলিমের?
* * *
বরদ-বিজয়ী বদরুদ্দোজা৪
ঘুচাল কি অমা রৌশনিতে?
সিজাদ করিল নিজ্দ হেজাজ৬
আবার ‘কাবা’র মসজিদে।
আরবে করিল ‘দারুল-হার’–
ধসে পড়ে বুঝি ‘কাবা’র ছাদ!
‘দীন দীন’রবে শমশের-হাতে
ছুটে শের-নর ‘ইবনে সাদ’!
মাজার ফাড়িয়া উঠিল হাজার
জিন্দান-ভাঙা জিন্দা বীর!
গারত হইল করদ হুসেন,
উঁচু হল পুন শির নবির!
আরব আবার হল আরাস্তা,
বান্দারা যত পড়ে দরুদ।
পড়ে শুকরানা‘আরবা রেকাত’
আরফাতে যত স্বর্গ-দূত।
ঘোষিল ওহদ, ‘আল্লা আহদ !’
ফুকারে তূর্য তুর পাহাড়
মন্দ্রে বিশ্ব-রন্ধ্রে-রন্ধ্রে
মন্ত্র আল্লা-হু-আকবার!
জাগিয়া শুনিনু প্রভাতি আজান
দিতেছে নবীন মোয়াজ্জিন।
মনে হল এল ভক্ত বেলাল
রক্ত এ-দিনে জাগাতে দীন!
জেগেছে তখন তরুণ তুরাণ
গোর চিরে যেন আঙ্গোরায়।
গ্রিসের গরুরী গারত করিয়া
বোঁও বোঁও তলোয়ার ঘোরায়।
রংরেজ৭ যেন শমশের যত
লালফেজ-শিরে তুর্কিদের।
লালে-লাল করে কৃষ্ণসাগর
রক্ত-প্রবাল চূর্ণি ফের।
মোতি হার সম হাথিয়ার দোলে
তরুণ তুরাণি বুকে পিঠে!
খাট্টা-মেজাজ গাঁট্টা মারিছে
দেশ-শত্রুর গিঁঠে গিঁঠে!
মুক্ত চন্দ্র-লাঞ্ছিত ধ্বজা
পতপত ওড়ে তুর্কিতে,
রঙিন আজি ম্লান আস্তানা
সুরখ রঙের সুর্খিতে
বিরান১০ মুলুক ইরানও সহসা
জাগিয়াছে দেখি ত্যজিয়া নিদ!
মাশুকের বাহু ছাড়ায়ে আশিক
কসম করিছে হবে শহিদ!
লায়লির প্রেমে মজনুন আজি
‘লা-এলা’র তরে ধরেছে তেগ।
শিরীন শিরীরে ভুলে ফরহাদ
সারা ইসলাম পরে আশেক!
পেশতা-আপেল-আনার-আঙুর-
নারঙ্গি-শেব-বোস্তানে
মুলতুবি আজ সাকি ও শরাব
দীওয়ান-ই-হাফিজ জুজদানে!
নার্গিস লালা লালে-লাল আজি
তাজা খুন মেখে বীর প্রাণের,
ফিরদৌসীর রণ-দুন্দুভি
শুনে পিঞ্জরে জেগেছে শের!
হিংসায়-সিয়া শিয়াদের তাজে
শিরাজী-শোণিমা লেগেছে আজ।
নৌ-রুস্তম উঠেছে রুখিয়া
সফেদ দানবে দিয়াছে লাজ?
মরা মরক্কো মরিয়া হইয়া
মাতিয়াছে করি মরণ-পণ,
স্তম্ভিত হয়ে হেরিছে বিশ্ব–
আজও মুসলিম ভোলেনি রণ!
জ্বালাবে আবার খেদিব-প্রদীপ
গাজি আবদুল করিম বীর,
দ্বিতীয় কামাল রীফ-সর্দার–
স্পেন ভয়ে পায়ে নোয়ায় শির!
রীফ৬ শরিফ সে কতটুকু ঠাঁই
আজ তারই কথা ভুবনময়!–
মৃত্যুর মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ে
দেখেছে যাহারা, তাদেরই জয়!
মেষ-সম যারা ছিল এতদিন
শের হল আজ সেই মেসের!
এ-মেষের দেশ মেষ-ই রহিল
কাফ্রির অধম এরা কাফের!
নীল দরিয়ায় জেগেছে জোয়ার
‘মুসা’র উষার টুটেছে ঘুম।
অভিশাপ-‘আসা’ গর্জিয়া আসে
গ্রাসিবে যন্ত্রী-জাদু-জুলুম।
ফেরাউন১ আজও মরেনি ডুবিয়া?
দেরি নাই তার, ডুবিবে কাল!
জালিম-রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে
জ্বলেছে খোদার লাল মশাল!
কাবুল লইল নতুন দীক্ষা
কবুল করিল আপনা জান।
পাহাড়ি তরুর শুকনো শাখায়
গাহে বুলবুল খোশ এলহান!
পামির ছাড়িয়া আমির আজিকে
পথের ধুলায় খোঁজে মণি!
মিলিয়াছে মরা মরু-সাগরে রে
আব-হায়াতের৩ প্রাণ-খনি!
খর-রোদ-পোড়া খর্জুর তরু–
তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর!
“সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা”
ভারতের বুকে নাই রুধির!
জাগিল আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।–
সর্বনাশের পরে পৌষমাস
এলো কি আবার ইসলামের?
* * *
কসাই-খানার সাত কোটি মেষ
ইহাদেরই শুধু নাই কি ত্রাণ
মার খেয়ে খেয়ে মরিয়া হইয়া
উঠিতে এদের নাই প্রাণ?
জেগেছে আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।
এয়্ খোদা! এই জাগরণ-রোলে
এ-মেষের দেশও জাগাও ফের!
হুগলি,
অগ্রহায়ণ, ১৩৩১
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
বার্ষিক সওগাত
Friday, May 18, 2018, 3:23 AM
বন্ধু গো সাকি আনিয়াছ নাকি বরষের সওগাত –
দীর্ঘ দিনের বিরহের পরে প্রিয়-মিলনের রাত।
রঙিন রাখি, শিরীন শারাব, মুরলী, রবাব, বীণ,
গুলিস্তানের বুলবুল পাখি, সোনালি রুপালি দিন।
লালা-ফুল সম দাগ-খাওয়া দিল, নার্গিস-ফুলি আঁখ,
ইস্পাহানির হেনা-মাখা হাত, পাতলি কাঁখ!
নৈশাপুরের গুলবদনির চিবুক গালের টোল,
রাঙা লেড়কির ভাঙা ভাঙা হাসি, শিরীন শিরীন বোল।
সুরমা-কাজল স্তাম্বুলি চোখ, বসোরা গুলের লালি,
নব বোগাদাদি আলিফ-লায়লা, শাজাদি জুলফ-ওয়ালি।
পাকা খর্জুর, ডাঁশা আঙ্গুর, টোকো-মিঠে কিসমিস,
মরু-মঞ্জীর আব-জমজম,যবের ফিরোজা শিস।
আশা-ভরা মুখ,তাজা তাজা বুক, নৌ-জোয়ানির গান,
দুঃসাহসীর মরণ-সাধনা, জেহাদের অভিযান।
আরবের প্রাণ, ফারেসের বাজু নৌ-তুর্কির,
দারাজ দিলীর আফগানি দিল, মূরের জখমি শির।
নীল দরিয়ায় মেসেরের আঁসু, ইরাকের টুটা তখ্ত,
বন্দী শামের জিন্দান-খানা, হিন্দের বদবখ্ত! –
তাঞ্জাম-ভরা আঞ্জাম এ যে কিছুই রাখনি বাকি,
পুরানো দিনের হাতে বাঁধিয়াছ নতুন দিনের রাখি।…
চোখের পানির ঝালর-ঝুলানো হাসির খাঞ্চাপোশ
– যেন অশ্রুর গড়খাই-ঘেরা দিল্খোস ফেরদৌস –
ঢাকিয়ো বন্ধু তব সওগাতি-রেকাবি তাহাই দিয়ে,
দিবসের জ্বালা ভুলে যেতে চাই রাতের শিশির পিয়ে !
বেদনার বানে সয়লাব সব, পাইনে সাথির হাত,
আনো গো বন্ধু নূহের কিশতি– ‘বার্ষিকী সওগাত!’
[কৃষ্ণনগর
২৫ অগ্রহায়ণ,১৩৩৩]
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
নাকিব
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
নব-জীবনের নব-উত্থান-আজান ফুকারি এসো নকিব।
জাগাও জড়! জাগাও জীব!
জাগে দুর্বল, জাগে ক্ষুধা-ক্ষীণ,
জাগিছে কৃষাণ ধুলায়-মলিন,
জাগে গৃহহীন, জাগে পরাধীন
জাগে মজলুম বদ-নসিব!
মিনারে মিনারে বাজে আহ্বান –
‘আজ জীবনের নব উত্থান!’
শঙ্কাহরণ জাগিছে জোয়ান
জাগে বলহীন জাগিছে ক্লীব,
নব জীবনের নব উত্থান –
আজান ফুকারি এসো নকিব!
হুগলি,
১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
জীবন
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
জাগরণের লাগল ছোঁয়াচ মাঠে মাঠে তেপান্তরে,
এমন বাদল ব্যর্থ হবে তন্দ্রাকাতর কাহার ঘরে?
তড়িৎ ত্বরা দেয় ইশারা, বজ্র হেঁকে যায় দরজায়,
জাগে আকাশ, জাগে ধরা−ধরার মানুষ কে সে ঘুমায়?
মাটির নীচে পায়ের তলায় সেদিন যারা ছিল মরি,
শ্যামল তৃণাঙ্কুরে তারা উঠল বেঁচে নতুন করি;
সবুজ ধরা দেখছে স্বপন আসবে কখন ফাগুন-হোলি,
বজ্রাঘাতে ফুটল না যে, ফুটবে আনন্দে সে কলি!
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
খোশ আমদেদ
Friday, May 18, 2018, 1:19 AM
আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি।
ও চরণ ছুঁই কেমন হাতে মোর মাখা যে কালি॥
দখিনের হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতি
শবে-রাত আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥
তালিবান ঝুমকি বাজায়, গায় মোবারক-বাদ৪ কোয়েলা।
উলসি উপচে পলো পলাশ অশোক ডালের ওই ডালি॥
প্রাচীন ওই বটের ঝুরির দোলনাতে হায় দুলিছে শিশু।
ভাঙা ওই দেউল-চূড়ে উঠল বুঝি নৌ-চাঁদের ফালি॥
এল কি অলখ-আকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ।
এল কি আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েস গাজ্জালি৫॥
সানাইয়াঁ ভয়রোঁ বাজায়, নিদ-মহলায় জাগল শাহজাদি।
কারুণের রুপার পুরে নূপুর-পায়ে আসল রূপ-ওয়ালি।
খুশির এ বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরীঁ।
লাল এ লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি॥
বাসি ফুল কুড়িয়ে মালা না-ই গাঁথিলি, রে ফুল-মালি!
নবীনের আসার পথে উজাড় করে দে ফুল ডালি॥
পদ্মা
২৭.২.২৭
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
খালেদ
Friday, May 18, 2018, 3:26 AM
খালেদ! খালেদ! শুনিতেছে নাকি সাহারার আহা-জারি?
কত ‘ওয়েসিস’ রচিল তাহার মরু-নয়নের বারি।
মরীচিকা তার সন্ধানী-আলো দিকে দিকে ফেরে খুঁজি
কোন নিরালায় ক্লান্ত সেনানী ডেরা গাড়িয়াছ বুঝি!
বালু-বোররাকে সওয়ার হইয়া ডাক দিয়া ফেরে ‘লু’,
তব তরে হায়! পথে রেখে যায় মৃগীরা মেশক-বু!
খর্জুর-বীথি আজিও ওড়ায় তোমার জয়ধ্বজা,
তোমার আশায় বেদুইন-বালা আজিও রাখিছে রোজা।
‘মোতাকারিব’-এর ছন্দে উটের সারি দুলে দুলে চলে,
দু-চোখ তাদের দিশাহারা পথে আলেয়ার মতো জ্বলে।
‘খালেদ! খালেদ!’পথ-মঞ্জিলে ক্লান্ত উটেরা কহে,
“বণিকের বোঝা বহা তো মোদের চিরকেলে পেশা নহে!”
‘সুতুর-বানের’ বাঁশি শুনে উট উল্লাস-ভরে নাচে,
ভাবে, নকিবের বাঁশরির পিছে রণ-দামামাও আছে।
ন্যুব্জ এ পিঠ খাড়া হত তার সওয়ারের নাড়া পেয়ে,
তলওয়ার তির গোর্জ নেজায় পিঠ যেত তার ছেয়ে।
খুন দেখিয়াছে, তূণ বহিয়াছে, নুন বহেনিকো কভু!
* * *
বালু ফেড়ে ওঠে রক্ত-সূর্য ফজরের শেষে দেখি,
দুশমান-খুনে লাল হয়ে ওঠে খালেদি আমামা এ কী!
খালেদ! খালেদ! ভাঙিবে নাকি ও হাজার বছরি ঘুম?
মাজার ধরিয়া ফরিয়াদ করে বিশ্বের মজলুম!–
শহিদ হয়েছ? ওফাত হয়েছে? ঝুটবাত! আলবত!
খালেদের জান কব্জ করিবে ওই মালেকুল-মৌত?
বছর গিয়াছে গেছে শতাব্দী যুগযুগান্ত কত,
জালিম৯ পারসি রোমক রাজার জুলুম সে শত শত
রাজ্য ও দেশ গেছে ছারেখারে! দুর্বল নরনারী
কোটি কোটি প্রাণ দিয়াছে নিত্য কত্ল-গাহেতে তারই!
উৎপীড়িতের লোনা আঁসু-জলে গলে গেল কত কাবা,
কত উজ তাতে ডুবে মলো হায়, কত নূহ্ হল তাবা!
সেদিন তোমার মালেকুল-মৌত কোথায় আছিল বসি?
কেন সে তখন জালিম রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে পশি
বেছে বেছে ওই ‘সঙ্গ্-দিল’দের কব্জ করেনি জান?
মালেকুল-মৌত সেদিনও মেনেছে বাদশাহি ফরমান!–
মক্কার হাতে চাঁদ এল যবে তকদিরে আফতাব
কুল-মখলুক দেখিতে লাগিল শুধু ইসলামি খাব,
শুকনো খবুজ খোর্মা চিবায়ে উমর দারাজ-দিল
ভাবিছে কেমন খুলিবে আরব দিন-দুনিয়ার খিল, –
এমন সময় আসিল জোয়ান হাথেলিতে হাথিয়ার,
খর্জুর-শিষে ঠেকিয়াছে গিয়া উঁচা উষ্ণীয় তার!
কব্জা তাহার সব্জা হয়েছে তলওয়ার-মুঠ ডলে,
দু-চোখ ঝালিয়া আশায় দজ্লা ফোরাত পড়িছে গলে!
বাজুতে তাহার বাঁধা কোর-আন, বুকের দুর্মদ বেগ,
আলবোরজের চূড়া গুঁড়া-করা দস্তে দারুণ তেগ।
নেজার৪ ফলক উল্কার সম উগ্রগতিতে ছোটে,
তির খেয়ে তার আশমান-মুখে তারা-রূপে ফেনা ওঠে।
দারাজ দস্ত যেদিকে বাড়ায় সেইদিক পড়ে ভেঙে,
ভাস্কর-সম যেদিকে তাকায় সেইদিক ওঠে রেঙে!
ওলিদের বেটা খালেদ সে বীর যাহার নামের ত্রাসে
পারস্য-রাজ নীল হয়ে উঠে ঢলে পড়ে সাকি-পাশে!
রোম-সম্রাট শারাবের জাম -হাতে থরথর কাঁপে,
ইস্তাম্বুলি বাদশার যত নজ্জুম আয়ু মাপে!
মজলুম যত মোনাজাত করে কেঁদে কয় “এয়্ খোদা,
খালেদের বাজু-শমশের রেখো সহি-সালামতে সদা।”
আজরাইলও সে পারেনি এগুতে যে আজাজিলের আগে,
ঝুঁটি ধরে তার এনেছে খালেদ, ভেড়ি ধরে যেন বাঘে!
মালেকুল-মৌত করিবে কব্জ রু্হ্ সেই খালেদের?–
হাজার হাজার চামড়া বিছায়ে মাজারে ঘুমায় শের!
খালেদ! খালেদ! ফজর হল যে, আজান দিতেছে কৌম,
ওই শোনো শোনো –”আস্সালাতু খায়র মিনান্নৌম!”
যত সে জালিম রাজা-বাদশারে মাটিতে করেছে গুম
তাহাদেরই সেই খাকেতে খালেদ করিয়া তয়ম্মুখ
বাহিরিয়া এসো, হে রণ-ইমাম, জামায়েত আজ ভারী!
আরব, ইরান, তুর্ক, কাবুল দাঁড়ায়েছে সারি সারি!
আব-জমজম উথলি উঠিছে তোমার ওজুর তরে,
সারা ইসলাম বিনা ইমামেতে আজিকে নামাজ পড়ে!
খালেদ! খালেদ! ফজরে এলে না, জোহরকাটানু কেঁদে,
আসরে ক্লান্ত ঢুলিয়াছি শুধু বৃথা তহ্রিমা বেঁধে!
এবে কাফনের খেলকা পরিয়া চলিয়াছি বেলা-শেষে,
মগ্রেবের আজ নামাজ পড়িব আসিয়া তোমার দেশে!
খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু,
সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু!
তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা,
মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরই বিভীষিকা!
হঠিতে হঠিতে আসিয়া পড়েছি আখেরি গোরস্থানে,
মগ্রেব-বাদে এশার১ নামাজ পাব কিনা কে সে জানে!
খালেদ! খালেদ! বিবস্ত্র মোরা পরেছি কাফন শেষে,
হাথিয়ার-হারা, দাঁড়ায়েছি তাই তহ্রিমা বেঁধে এসে!
ইমামতি তুমি করিবে না জানি, তুমি গাজি মহাবীর,
দিন-দুনিয়ার শহিদ নোয়ায় তোমার কদমে শির!
চারিটি জিনিস চিনেছিলে মতুমি, জানিতে না হের-ফের,
আল্লা, রসুল, ইসলাম আর শের-মারা শমশের!
খিলাফত তুমি চাওনিকো কভু চাহিলে – আমরা জানি, –
তোমার হাতের বে-দেরেগ৩ তেগ অবহেলে দিত আনি!
উমর যেদিন বিনা অজুহাতে পাঠাইল ফরমান, –
“সিপাহ্-সালার খালেদ পাবে না পূর্বের সম্মান,
আমার আদেশ – খালেদ ওলিদ সেনাপতি থাকিবে না,
সাদের অধীনে করিবে যুদ্ধ হয়ে সাধারণ সেনা!”
ঝরা জলপাই-পাতার মতন কাঁপিতে কাঁপিতে সাদ,
দিল ফরমান, নফসি নফসি জপে, গণে পরমাদ!
খালেদ! খালেদ! তাজিমের সাথে ফরমান পড়ে চুমি
সিপাহ-সালারের সকল জেওরখুলিয়া ফেলিলে তুমি।
শিশুর মতন সরল হাসিতে বদন উজালা করি
একে একে সব রেখে দিলে তুমি সাদের চরণ পরি!
বলিলে, “আমি তো সেনাপতি হতে আসিনি, ইবনে সাদ,
সত্যের তরে হইব শহিদ, এই জীবনের সাধ!
উমরের নয়, এ যে খলিফার ফরমান, ছি ছি আমি
লঙ্ঘিয়া তাহা রোজ-কিয়ামতে হব যশ-বদনামি?”
মার মুখো যত সেনাদলে ডেকে ইঙ্গিতে বুঝাইলে,
কুর্নিশ করি সাদেরে, মামুলি সেনাবাসে ডেরা নিলে!
সেনাদের চোখে আঁসু ধরে না কো, হেসে কেঁদে তারা বলে, –
“খালেদ আছিল মাথায় মোদের, এবার আসিল কোলে!”
মক্কায় যবে আসিলে ফিরিয়া, উমর কাঁদিয়া ছুটে,
এ কী রে, খলিফা কাহার বক্ষে কাঁদিয়া পড়িল লুটে!
“খালেদ! খালেদ!” ডাকে আর কাঁদে উমর পাগল-প্রায়
বলে, “সত্যই মহাবীর তুই, বুসা দিই তোকে, আয়!
তখ্তের পর তখ্ত যখন তোমার তেগের আগে
ভাঙিতে লাগিল, হাতুড়ি যেমন বাদামের খোসা ভাঙে, –
ভাবিলাম বুঝি তোমারে এবার মুগ্ধ আরব-বাসী
সিজদা করিবে, বীরপূজা বুঝি আসিল সর্বনাশী!
পরীক্ষা আমি করেছি খালেদ, ক্ষমা চাই ভাই ফের,
আজ হতে তুমি সিপাহ-সালার ইসলাম জগতের!”
খালেদ! খালেদ! কীর্তি তোমার ভুলি নাই মোরা কিছু,
তুমি নাই তাই ইসলাম আজ হটিতেছে শুধু পিছু।
পুরানো দামামা পিটিয়া পিটিয়া ছিঁড়িয়ে গিয়াছে আজ,
আমামা অস্ত্র ছিল নাকো তবু দামামা ঢাকিত লাজ!
দামামা তো আজ ফাঁসিয়া গিয়াছে, লজ্জা কোথায় রাখি,
নামাজ রোজার আড়ালেতে তাই ভীরুতা মোদের ঢাকি!
খালেদ! খালেদ! লুকাব না কিছু, সত্য বলিব আজি,
ত্যাগী ও শহিদ হওয়া ছাড়া মোরা আর সব হতে রাজি!
রীশ-ই বুলন্দ্, শেরওয়ানি, চোগা, তসবি ও টুপি ছাড়া
পড়ে নাকো কিছু, মুসলিম-গাছ ধরে যত দাও নাড়া!
* * *
খালেদ! খালেদ! সবার অধম মোরা হিন্দুস্থানি,
হিন্দু না মোরা মুসলিম তাহা নিজেরাই নাহি জানি!
সকলে শেষে হামাগুড়ি দিই, –না, না, বসে বসে শুধু
মুনাজাত৬করি, চোখের সুমুখে নিরাশা-সাহারা ধুধু!
দাঁড়ায়ে নামাজ পড়িতে পারি না, কোমর গিয়াছে টুটি,
সিজদা করিতে ‘বাবা গো’বলিয়া ধূলিতলে পড়ি লুটি!
পিছন ফিরিয়া দেখি লাল-মুখ আজরাইলের ভাই,
আল্লা ভুলিয়া বলি, “প্রভু মোর তুমি ছাড়া নাই।”
টক্কর খেতে খেতে শেষে এই আসিয়া পড়েছি হেথা,
খালেদ! খালেদ! রি রি করে বুকে পরাধীনতার ব্যথা!
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে!
হানফী, ওহাবী, লা-মজহাবীর৯ তখনও মেটেনি গোল,
এমন সময় আজাজিল এসে হাঁকিল, ‘তল্পি তোল!’
ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি, বাহিরের দিকে তত
গুনতিতে মোড়া বাড়িয়া চলেছি গোরু ছাগলের মতো!
খালেদ! খালেদ! এই পশুদের চামড়া দিয়ে কি তবে
তোমার পায়ের দুশমন-মারা দুটো পয়জারও হবে?
হায় হায় হায়, কাঁদে সাহারায় আজিও তেমনই ও কে?
দজলা-ফোরাত নতুন করিয়া মাতম করিছে শোকে!
খর্জুর পেকে খোর্মা হইয়া শুকায়ে পড়েছে ঝুরে
আঙুর বেদানা নতুন করিয়া বেদনার রসে পুরে।
এক রাশ শুখো আখরোট আর বাদাম ছাড়াতে লয়ে
আঙুল ছেঁচিয়া মুখ দিয়া চুষে মৌনা আরবি-বউয়ে!
জগতের সেরা আরবের তেজি যুদ্ধ-তাজির চালে
বেদুইন-কবি সংগীত রচি নাচিতেছে তালে তালে!
তেমনই করিয়া কাবার মিনারে চড়িয়া মুয়াজ্জিন
আজানের সুরে বলে, কোনোমতে আজও বেঁচে আছে দ্বীন!
খালেদ! খালেদ! দেখো দেখো ওই জমাতের পিছে কারা
দাঁড়ায়ে রয়েছে, নড়িতে পারে না, আহা রে সর্বহারা!
সকলের পিছে নহে বটে তবু জমাত-শামিল নয়,
উহাদের চোখে হিন্দের মতো নাই বটে নিদ্-ভয়!
পিরানের সব দামন ছিন্ন, কিন্তু সে সম্মুখে
পেরেশান৪ ওরা তবু দেখিতেছি ভাঙিয়া পড়েনি দুখে!
তকদির বেয়ে খুন ঝরে ওই উহারা মেসেরি বুঝি।
টলে তবু চলে বারে বারে হারে বারে বারে ওরা যুঝি।
এক হাতে বাঁধা হেম-জিঞ্জির আর এক হাত খোলা
কী যেন হারামি নেশার আবেশে চক্ষু ওদের ঘোলা!
ও বুঝি ইরাকি? খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখো, ওঠো,
শ্বেত-শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মুঠো!
দুহাতে দুপায়ে আড়-বেড়ি দেওয়া ও কারা চলিতে নারে,
চলিতে চাহিলে আপনার ভায়ে পিছন হইতে মারে।
মরদের মতো চেহারা ওদের স্বাধীনের মতো বুলি,
অলস দু-বাজু দু-চোখ সিয়াহ অবিশ্বাসের ঠুলি!
শামবাসী৭ ওরা সহিতে শেখেনি পরাধীনতার চাপ,
তলওয়ার নাই, বহিছে কটিতে কেবল শূন্যে খাপ!
খালেদ! খালেদ! মিসমার হল তোমার ইরাক শাম,
জর্ডন নদে ডুবিয়াছে পাক জেরুজালেমের নাম!
খালেদ! খালেদ! দুধারি তোমার কোথা সেই তলোয়ার?
তুমি ঘুমায়েছ, তলোয়ার তব সে তো নহে ঘুমাবার!
জং ধরেনিকো কখনও তাহাতে জঙ্গের খুনে নেয়ে,
হাথেলিতে তব নাচিয়া ফিরেছে যেন বেদুইন মেয়ে!
খাপে বিরামের অবসর তার মেলেনি জীবনে কভু,
জুলফিকার৩ সে দুখান হয়েছে, ও তেগ টুটেনি তবু।
তুমি নাই তাই মরিয়া গিয়াছে তরবারিও কি তব?
হাত গেছে বলে হাত-যশও গেল? গল্প এ অভিনব!
খালেদ! খালেদ! জিন্দা হয়েছে আবার হিন্দা৪ বুড়ি,
কত হামজারে মারে জাদুকরি, দেশে দেশে ফেরে উড়ি!
ও কারা সহসা পর্বত ভেঙে তুহিন স্রোতের মতো,
শত্রুর শিরে উন্মদবেগে পড়িতেছে অবিরত!
আগুনের দাহে গলিছে তুহিন আবার জমিয়া উঠে,
শির উহাদের ছুটে গেল হায়! তবু নাহি পড়ে টুটে!
ওরা মরক্কো মরদের জাত মৃত্যু মুঠার পরে,
শত্রুর হাতে শির দিয়া ওরা শুধু হাতে পায়ে লড়ে!
খালেদ! খালেদ! সর্দার আর শির পায় যদি মূর
খাসা জুতো তারা করিবে তৈরি খাল দিয়া শত্রুর!
খালেদ! খালেদ! জাজিরাতুল সে আরবের পাক মাটি
পলিদ হইল, খুলেছে এখানে যুরোপ পাপের ভাঁটি!
মওতের দারু পিইলে ভাঙে না হাজার বছরি ঘুম?
খালেদ! খালেদ! মাজার আঁকড়ি কাঁদিতেছে মজলুম।
খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের,
চাই না মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের।
কৃষ্ণনগর,
২১ অগ্রহায়ণ, ’৩৩
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
অগ্র-পথিক
Friday, May 18, 2018, 9:46 AM
অগ্র-পথিক হে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল।
রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন ভাইরা মোর,
বসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর!
রাখ তৈয়ার হাথেলিতে হাথিয়ার জোয়ান,
হান রে নিশিত পাশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ!
কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
কোথায় মানিক ভাইরা আমার, সাজ রে সাজ!
আর বিলম্ব সাজে না, চালাও কুচকাওয়াজ!
আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ
বিপদ বাধার কণ্ঠ ছিঁড়িয়া শুষিব খুন!
আমরা ফলাব ফুল-ফসল।
অগ্র-পথিক রে যুবাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর,
হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির!
দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ
সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,
মরু-সঞ্চর গতি-চপল।
অগ্র-পথিক রে পাঁওদল,
জোর কদম চল রে চল॥
স্থবির শ্রান্ত প্রাচী-র প্রাচীন জাতিরা সব
হারায়েছে আজ দীক্ষাদানের সে-গৌরব।
অবনত-শির গতিহীন তারা। মোরা তরুণ
বহিব সে ভার, লব শাশ্বত ব্রত দারুণ
শিখাব নতুন মন্ত্রবল।
রে নব পথিক যাত্রীদল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান,
চলমান-বেগে প্রাণ-উছল।
রে নবযুগের স্রষ্টাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
অভিযান-সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে
বনে নদীতটে গিরি-সংকটে জলে থলে।
লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমিষে,
জয় করি সব তসনস করি পায়ে পিষে,
অসীম সাহসে ভাঙি আগল!
না জানা পথের নকিব-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবিরে
বাঁধ বাঁধি চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে।
রসাতল চিরি হীরকের খনি করি খনন,
কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,
পায়ে হেঁটে মাপি ধরণিতল!
অগ্র-পথিক রে চঞ্চল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা এসেছি নবীন প্রাচী-র নবস্রোতে
ভীম পর্বত ক্রকচ-গিরির১ চূড়া হাতে,
উচ্চ অধিত্যকা প্রণালিকা হইয়া বার;
আহত বাঘের পদ-চিন ধরি হয়েছি বার ;
পাতাল ফুঁড়িয়া, পথ-পাগল।
অগ্রবাহিনী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আয়র্ল্যান্ড, আরব, মিশর, কোরিয়া চীন,
নরওয়ে, স্পেন, রাশিয়া, – সবার ধারি গো ঋণ!
সবার রক্তে মোদের লোহুর আভাস পাই,
এক বেদনার ‘কমরেড’ভাই মোরা সবাই।
সকল দেশের মোরা সকল ।
রে চির-যাত্রী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
বলগা্-বিহীন শৃঙ্খল-ছেঁড়া প্রিয় তরুণ!
তোদের দেখিয়া টগবগ করে বক্ষে খুন।
কাঁদি বেদনায়, তবু রে তোদের ভালোবাসায়
উল্লাসে নাচি আপনা-বিভোল,নব আশায়।
ভাগ্য-দেবীর লীলা-কমল,
অগ্রপথিক রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
তরুণ তাপস! নব শক্তিরে জাগায়ে তোল।
করুণার নয়–ভয়ংকরীর দুয়ার খোল।
নাগিনি-দশনা রণরঙ্গিণী শস্ত্রকর
তোর দেশ-মাতা, তাহারই পতাকা তুলিয়া ধর।
রক্ত-পিয়াসি অচঞ্চল
নির্মম-ব্রত রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত যুবারা, শুন!
মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু, শকুন।
ভ্রুকুটি হানিছে পুরাতন পচা গলিতে শব,
রক্ষণশীল বুড়োরা করছি তারই স্তব
শিবারা চেঁচাক, শিব অটল!
নির্ভীক বীর পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আগে – আরও আগে সেনা-মুখ যথা করিছে রণ,
পলকে হতেছে পূর্ণ মৃতের শূন্যাসন,
আছে ঠাঁই আছে, কে থামে পিছনে? হ আগুয়ান!
যুদ্ধের মাঝে পরাজয় মাঝ চলো জোয়ান!
জ্বাল রে মশাল জ্বাল অনল!
অগ্রযাত্রী রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
নতুন করিয়া ক্লান্ত ধরার মৃত শিরায়
স্পন্দন জাগে আমাদের তরে, নব আশায়।
আমাদেরই তারা – চলিছে যাহারা দৃঢ় চরণ
সম্মুখ পানে, একাকী অথবা শতেক জন।
মোরা সহস্র-বাহু-সবল।
রে চির-রাতের সন্ত্রিদল,
জোর কদম চল রে চল॥
জগতের এই বিচিত্রতম মিছিলে ভাই
কত রূপ কত দৃশ্যের লীলা চলে সদাই!–
শ্রমরত ওই কালি-মাখা কুলি, নৌ-সারং,
বলদের মাঝে হলধর চাষা দুখের সং,
প্রভু স-ভৃত্য পেষণ-কল, –
অগ্র-পথিক উদাসী-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
নিখিল গোপন ব্যর্থ-প্রেমিক আর্ত-প্রাণ
সকল কারার সকল বন্দী আহত-মান,
ধরার সকল সুখী ও দুঃখী, সৎ, অসৎ,
মৃত, জীবন্ত, পথ-হারা, যারা ভোলেনি পথ, –
আমাদের সাথি এরা সকল।
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোরকদম চল রে চল॥
ছুঁড়িতেছে ভাঁটা জ্যোতির্চক্র ঘূর্ণমান
হেরো পুঞ্জিত গ্রহ-রবি-তারা দীপ্তপ্রাণ;
আলো-ঝলমল দিবস, নিশীথ স্বপ্নাতুর, –
বন্ধুর মতো চেয়ে আছে সবে নিকট-দূর।
এক ধ্রুব সবে পথ-উতল।
নব যাত্রিক পথিক দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমাদের এরা, আছে এরা সবে মোদের সাথ,
এরা সখা – সহযাত্রী মোদের দিবস-রাত।
ভ্রূণ-পথে আসে মোদের পথের ভাবী পথিক,
এ মিছিলে মোরা অগ্র-যাত্রী সুনির্ভিক।
সুগম করিয়া পথ পিছল
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
ওগো ও প্রাচী-র দুলালি দুহিতা তরুণীরা,
ওগো জায়া ওগো ভগিনীরা। ডাকে সঙ্গীরা।
উঠুক তোমার মণি-মঞ্জীর ঘন বাজি
আমাদের পথে চল-চপল।
অগ্র-পথিক তরুণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
ওগো অনাগত মরু-প্রান্তর বৈতালিক!
শুনিতেছি তব আগমনি-গীতি দিগ্বিদিক।
আমাদেরই মাঝে আসিতেছ তুমি দ্রুত পায়ে। –
ভিন-দেশী কবি! থামাও বাঁশরি বট-ছায়ে,
তোমার সাধনা আজি সফল।
অগ্র-পথিক চারণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চাহি না তরল স্বপন, হালকা সুখ,
আরাম-কুশন, মখমল-চটি, পানসে থুক
শান্তির বাণী, জ্ঞান-বানিয়ার বই-গুদাম,
ছেঁদো ছন্দের পলকা, উর্ণা, সস্তা নাম,
পচা দৌলত; – দুপায়ে দল!
কঠোর দুখের তাপসদল,
জোর কদম চল রে চল॥
পান-আহার ভোজে মত্ত কি যত ঔদরিক?
দুয়ার জানালা বন্ধ করিয়া ফেলিয়া চিক
আরাম করিয়া ভুঁড়োরা ঘুমায়?–বন্ধু, শোন,
মোটা ডালরুটি, ছেঁড়া কম্বল,ভূমি-শয়ন,
আছে তো মোদের পাথেয়-বল!
ওরে বেদনার পূজারি দল,
মোছ রে অশ্রু, চল রে চল॥
নেমেছে কি রাতি? ফুরায় না পথ সুদুর্গম?
কে থামিস পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম?
বসে নে খানিক পথ-মঞ্জিলে, ভয় কী ভাই,
থামিলে দুদিন ভোলে যদি লোকে – ভুলুক তাই!
মোদের লক্ষ্য চির-অটল!
অগ্র-পথিক ব্রতীর দল,
বাঁদরে বুক, চল রে চল॥
শুনিতেছি আমি, শোন ওই দূরে তূর্য-নাদ
ঘোষিছে নবীন উষার উদয়-সুসংবাদ!
ওরে ত্বরা কর! ছুটে চল আগে – আরও আগে!
গান গেয়ে চলে অগ্র-বাহিনী, ছুটে চল তারও পুরোভাগে!
তোর অধিকার কর দখল!
অগ্র-নায়ক রে পাঁওদল!
জোর কদম চল রে চল॥
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
আশা (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
Friday, May 18, 2018, 1:44 AM
মহান তুমি প্রিয়
এই কথাটির গৌরবে মোর চিত্ত ভরে দিয়ো।
অনেক আশায় বসে আছি যাত্রা-শেষের পর
তোমায় নিয়েই পথের পারে বাঁধব আমার ঘর –
হে চির-সুন্দর!
পথ শেষ সেই তোমায় যেন করতে পারি ক্ষমা,
হে মোর কলঙ্কিনী প্রিয়তমা!
সেদিন যেন বলতে পারি, ‘এসো এসো প্রিয়,
বক্ষে এসো এসো আমার পূত কমনীয়!’
হায় হারানো লক্ষ্মী আমার! পথ ভুলেছ বলে
চির-সাথি যাবে তোমার মুখ ফিরিয়ে চলে?
জান ওঠে হায় মোচড় খেয়ে চলতে পড়ি টলে –
অনেক জ্বালায় জ্বলে প্রিয় অনেক ব্যথায় গলে!
বারে বারে নানান রূপে ছলতে আমায় শেষে,
কলঙ্কিনী! হাতছানি দাও সকল পথে এসে
কুটিল হাসি হেসে?
ব্যথায় আরো ব্যথা হানাই যে সে!
তুমি কি চাও তোমার মতোই কলঙ্কী হই আমি?
তখন তুমি সুদূর হতে আসবে ঘরে নামি –
হে মোর প্রিয়, হে মোর বিপথগামী!
পথের আজও অনেক বাকি,
তাই যদি হয় প্রিয় –
পথের শেষে তোমায় পাওয়ার যোগ্য করেই নিয়ো॥
(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
অবসর
Thursday, May 17, 2018, 5:26 PM
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার,
অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।
দিনের পর দিন গিয়েছে হয়নি আমার ছুটি,
বুকের ভিতর ব্যর্থ কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি
বসে ঢুলত আঁখি দুটি!
আহা আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া
লাগল চোখে তোমার চাওয়া
তাইতো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।
তোমার তরে বুকের তলায় অনেক দিনের অনেক কথা জমা,
কানের কাছে মুখটি থুয়ে গোপন সে-সব কইব প্রিয়তমা!
এবার শুধু কথায় গানে রাত্রি হবে ভোর
শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর
অভি-মানিনীরে মোর!
যখন তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি
মলিন মুখে ফুটবে হাসি,
হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি
অরুণ ছবি তার।
(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
হারামণি
Thursday, May 17, 2018, 5:33 PM
এমন করে অঙ্গনে মোর ডাক দিলি কে স্নেহের কাঙালি!
কে রে ও তুই কে রে?
আহা ব্যথার সুরে রে,
এমন চেনা স্বরে রে,
আমার ভাঙা ঘরের শূন্যতারই বুকের পরে রে।
এ কোন পাগল স্নেহ-সুরধুনীর আগল ভাঙালি?
কোন্ জননির দুলাল রে তুই, কোন্ অভাগির হারামণি,
চোখ-ভরা তোর কাজল চোখে রে
আহা ছলছল কাঁদন চাওয়ার সজল ছায়া কালো মায়া
সারাখনই উছলে যেন পিছল ননি রে!
মুখভরা তোর ঝরনাহাসি
শিউলি সম রাশি রাশি
আমার মলিন ঘরের বুকে মুখে লুটায় আসি রে!
বুক-জোড়া তোর ক্ষুদ্ধ স্নেহ দ্বারে দ্বারে কর হেনে যে যায়
কেউ কি তারে ডাক দিল না? ডাকল যারা তাদের কেন
দলে এলি পায়?
কেন আমার ঘরের দ্বারে এসেই আমার পানে চেয়ে এমন
থমকে দাঁড়ালি?
এমন চমকে আমায় চমক লাগালি?
এই কি রে তোর চেনা গৃহ, এই কিরে তোর চাওয়া স্নেহ হায়!
তাই কি আমার দুখের কুটির হাসির গানের রঙে রাঙালি?
হে মোর স্নেহের কাঙালি।
এ সুর যেন বড়োই চেনা, এ স্বর যেন আমার বাছার,
কখন সে যে ঘুমের ঘোরে হারিয়েছিনু হয় না মনে রে!
না চিনেই আজ তোকে চিনি, আমারই সেই বুকের মানিক,
পথ ভুলে তুই পালিয়ে ছিলি সে কোন ক্ষণে সে কোন বনে রে!
দুষ্টু ওরে, চপল ওরে, অভিমানী শিশু!
মনে কি তোর পড়ে না তার কিছু?
সেই অবধি জাদুমণি কত শত জনম ধরে
দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে রে,
আমি মা-হারা সে কতই ছেলের কতই মেয়ের
মা হয়ে বাপ খুঁজেছি তোরে!
দেখা দিলি আজকে ভোরে রে!
উঠছে বুকে হাহা ধ্বনি
আয় বুকে মোর হারামণি,
আমি কত জনম দেখিনি যে ওই মু-খানি রে!
পেটে-ধরা নাই বা হলি, চোখে ধরার মায়াও নহে এ,
তোকে পেতেই জন্ম জন্ম এমন করে বিশ্ব-মায়ের
ফাঁদ পেতেছি যে!
আচমকা আজ ধরা দিয়ে মরা-মায়ের ভরা-স্নেহে হঠাৎ জাগালি।
গৃহহারা বাছা আমার রে!
চিনলি কি তুই হারা-মায়ে চিনলি কি তুই আজ?
আজকে আমার অঙ্গনে তোর পরাজয়ের বিজয়-নিশান
তাই কি টাঙালি?
মোর স্নেহের কাঙালি।
(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
হার-মানা-হার
Friday, May 18, 2018, 3:14 AM
তোরা কোথা হতে কেমনে এসে
মণি-মালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি।
আমার পথিক-জীবন এমন করে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।
আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে
তারা হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে,
তোরা কেমন করে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে
ওই কচি বাহুর রেশমি ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে!
তোরা চলতে গেলে পায়ে জড়াস,
‘না’ ‘না’ বলে ঘাড়টি নড়াস,
কেন ঘর-ছাড়াকে এমন করে
ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি।
ওরে চোখে তোদের জল আসে না–
চমকে ওঠে আকাশ তোদের
চোখের মুখের চপল হাসিতে।
ওই হাসিই তো মোর ফাঁসি হল,
ওকে ছিঁড়তে গেলে বুকে লাগে,
কাতর কাঁদন ছাপা যে ও হাসির রাশিতে!
আমি চাইলে বিদায় বলিস, ‘উঁহু,
ছাড়ব নাকো মোরা’
ওই একটু মুখের ছোট্ট মানাই এড়িয়ে যেতে নারি,
কত দেশ-বিদেশের কান্নাহাসির
বাঁধনছেঁড়ার দাগ যে বুকে পোরা,
তোরা বসলি রে সেই বুক জুড়ে আজ,
চিরজয়ীর রথটি নিলি কাড়ি।
ওরে দরদিরা! তোদের দরদ
শীতের বুকে আনলে শরৎ,
তোরা ঈষৎ-ছোঁয়ায় পাথরকে আজ
কাতর করে অশ্রুভরা ব্যথায় ভরালি।
(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
Friday, May 18, 2018, 5:32 AM
॥ ১॥
বন্ধন
Friday, May 18, 2018, 3:08 AM
অনন্তকাল এ-অনন্তলোকে
মন-ভোলানোরে তার খুঁজে ফিরে মন।
দক্ষিণা-বায় চায় ফুল-কোরকে ;
পাখি চায় শাখী, লতা-পাতা-ঘেরা বন।
বিশ্বের কামনা এ – এক হবে দুই ;
নূতনে নূতনতর দেখিবে নিতুই॥
তোমারে গাওয়াত গান যার বিরহ
এড়িয়ে চলার ছলে যাচিয়াছ যায়,
এল সেই সুদূরের মদির-মোহ
এল সেই বন্ধন জড়াতে গলায়।
মালা যে পরিতে জানে, কন্ঠে তাহার
হয় না গলার ফাঁসি চারু-ফুলহার॥
জলময়, নদী তবু নহে জলাশয়,
কূলে কূলে বন্ধন তবু গাহে গান ;
বুকে তরণির বোঝা কিছু যেন নয়–
সিন্ধুর সন্ধানী চঞ্চল-প্রাণ।
দুই পাশে থাক তব বন্ধন-পাশ,
সমুখে জাগিয়া থাক সাগর-বিলাস॥
বিরহের চখাচখি রচে তারা নীড়,
প্রাতে শোনে নির্মল বিমানের ডাক ;
সেই ডাকে ভোলে নীড়, ভোলে নদীতীর,
সন্ধ্যায় গাহে : ‘এই বন্ধন থাক’!
আকাশের তারা থাক কল্পলোকে,
মাটির প্রদীপ থাক জাগর-চোখে॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
ঘোষণা
Friday, May 18, 2018, 10:25 AM
হাতে হাত দিয়ে আগে চলো, হাতে
নাই থাক হাতিয়ার!
জমায়েত হও, আপনি আসিবে
শক্তি জুলফিকার॥
আনো আলির শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,
ওমরের মতো কর্মানুরাগ,
খালেদের মতো সব অসাম্য
ভেঙে করো একাকার॥
ইসলামে নাই ছোটো বড়ো আর
আশরাফ আতরাফ;
এই ভেদ-জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে
করো মিসমার সাফ!
চাকর সৃজিতে চাকরি করিতে
ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে;
মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,
কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন,
এ-জুলুম সহেনিকো ইসলাম –
সহিবে না আজও আর॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
গান
Friday, May 18, 2018, 11:28 AM
আমার বিফল পূজাঞ্জলি
অশ্রু-স্রোতে যায় যে ভেসে।
তোমার আরাধিকার পূজা
হে বিরহী, লও হে এসে।
খোঁজে তোমায় চন্দ্র তপন,
পূজে তোমায় বিশ্বভুবন,
আমার যে নাথ ক্ষণিক জীবন
মিটবে কি সাধ ভালোবেসে॥
না-দেখা মোর বন্ধু ওগো,
কোথায় বাঁশি বাজাও একা,
প্রাণ বোঝে তা অনুভবে
নয়ন কেন পায় না দেখা!
সিন্ধু যেমন বিপুল টানে
তটিনীরে টেনে আনে,
তেমনি করে তোমার পানে
আমায় ডাকো নিরুদ্দেশে॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
কর্থ্যভাষা
Thursday, May 17, 2018, 8:44 PM
কর্থ্যভাষা কইতে নারি শুর্দ্ধ কথা ভিন্ন।
নেড়ায় আমি নিম্ন বলি (কারণ) ছেঁড়ায় বলি ছিন্ন॥
গোঁসাইকে কই গোস্বামী, তাই মশাইকে মোর্স্বামী।
বানকে বলি বন্যা, আর কানকে কন্যা কই আমি॥
চাষায় আমি চশ্শ বলি, আশায় বলি অশ্ব।
কোটকে বলি কোষ্ঠ, আর নাসায় বলি নস্য॥
শশারে কই শিষ্য আমি, ভাষারে কই ভীষ্ম।
পিসিরে কই পিষ্টক আর মাসিরে মাহিষ্য॥
পুকুরকে কই প্রুষ্করিণী, কুকুরকে কই ক্রুক্কু।
বদনকে কই বদনা, আর গাড়ুকে গুড়ুক্কু॥
চাঁড়ালকে কই চণ্ডাল, তাই আড়ালকে অণ্ডাল।
শালারে কই শলাকা, আর কালায় বলি কঙ্কাল॥
শ্বশুরকে কই শ্মশ্রু, আর দাদাকে কই দদ্রু।
বামারে কই বম্বু, আর কাদারে কই কদ্রু॥
আরও অনেক বাত্রা জানি, বুঝলে ভায়া মিন্টু।
ভেবেছ সব শিখে নেবে, বলছিনে আর কিন্তু॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
উঠিয়াছে ঝড়
Friday, May 18, 2018, 10:37 AM
উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিছে তার,
ওরে ভীরু, ওঠ, এখনই টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার!
কৃষ্ণ মেঘের নিশান তাহার দোলে পশ্চিম-তোরণে ওই,
ভ্রুকুটি- ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে নাচে নদনদী তাথই থই।
তরবারি তার হানিছে ঝিলিক সর্পিল বিদ্যুল্লেখায়,
হানিবে আঘাত তোর স্বপ্নের শিশমহলের দরোয়াজায় ;
কাঁদিবে পূর্ব পুবালি হাওয়ায়, ফোটাবে কদম জুঁই কুসুম ;
বৃষ্টিধারায় ঝরিবে অশ্রু, ঘনালে প্রলয় রবে নিঝুম?
যে দেশে সূর্য ডোবে – সেই দেশে হইল নবীন সূর্যোদয়,
উদয়-অচলে টলমল করে অস্ত-রবির আঁধার ভয়!
যুগ যুগ ধরি, তপস্যা দিয়ে করেছি মহিরে মহামহান,
ফুটায়েছি ফুল কর্ষিয়া মরু, ধূলির ঊর্ধ্বে গেয়েছি গান।
আজি সেই ফুলে-ফসল-মেলায় অধিকার নাই আমাদেরই,
আমাদের ধ্যান-সুন্দর ধরা আমাদের নয় আজি হেরি!
গীত-শেষে নীড়ে ফিরিবার বেলা হেরি নীড়ে বাসা বাঁধে শকুন,
মাংস-লোলুপ ফিরিতেছে ব্যাধ স্কন্ধে রক্ত-ধনুর্গুণ!
নীড়ে ফিরিবার পথ নাই তোর, নিম্নে নিষাদ, ঊর্ধ্বে বাজ,
তোর সে অতীত মহিমা আজিকে তোরে সব চেয়ে হানিছে লাজ!
উঠিয়াছে ঝড় – ঝড় উঠিয়াছে প্রলয়-রণের আমন্ত্রণ,
‘আদাওতি’র এ দাওতে কে যাবি মৃত্যুতে প্রাণ করিয়া পণ?
ঝড়ে যা উড়িবে, পুড়িবে আগুনে, উড়ুক পুড়ুক সে সম্বল,
মৃত্যু যেখানে ধ্রুব তোর সেথা মৃত্যুরে হেসে বরিবি চল!
অপরিমাণ এ জীবনে করিবি জীবিতের মতো ব্যয় যদি,
ঊর্ধ্বে থাকুক ঝড়ের আশিস, চরণে মরণ-অম্বুধি!
বিধাতার দান এই পবিত্র দেহের করিবি অসম্মান?
শকুন-শিবার খাদ্য হইবি, ফিরায়ে দিবি না খোদার দান?
এ-জীবন ফুল-অঞ্জলি সম নজরানা দিবি মৃত্যুরে, –
জীবিতের মতো ভুঞ্জি জীবন ব্যয় করে যা তা প্রাণ পুরে!
চরণে দলেছি বিপুলা পৃথ্বী কোটি গ্রহ তারা ধরি শিরে,
মোদের তীর্থ লাগি রবি শশী নিশিদিন আসে ফিরে ফিরে।
নিঃসীম নভ ছত্র ধরিয়া, বন্দনা-গান গাহে বিহগ,
বর্ষায় ঝরে রহমত-পানি-প্রতীক্ষমাণ সাত স্বরগ।
অপরিমাণ এ দানেরে কেমনে করিবি, রে ভীরু অস্বীকার?
মৃত্যুর মারফতে শোধ দিব বিধির এ মহাদানের ধার।
রোগ-পাণ্ডুর দেহ নয় – দিব সুন্দর তনু কোরবানি,
রোগ ও জরারে দিব না এ দেহ, জীবন-ফুলের ফুলদানি।
তাজা এ স্বাস্থ্য সুন্দর দেহ মৃত্যুরে দিবি অর্ঘ্যদান,
অতিথিরে দিবি কীটে-খাওয়া ফুল? লতা ছিঁড়ে তাজা কুসুম আন!
আসিয়াছে ঝড়, ঘরের ভিতর তাজিম করিয়া অতিথে ডাক,
বন্ধুর পথে এসেছে বন্ধু, হাসিয়া দস্তে দস্ত রাখ।
যৌবন-মদ পূর্ণ করিয়া জীবনের মৃৎপাত্র ভর,
তাই নিয়ে সব বেহুঁশ হইয়া ঝঞ্ঝার সাথে পাঞ্জা ধর।
ঝঞ্ঝার বেগ রুধিতে নারিবে পড়-পড় ওই গৃহ রে তোর,
খুঁটি ধরে তার কেন বৃথা আর থাকিস বসিয়া, ভাঙ এ দোর!
রবির চুল্লি নিভিয়া গিয়াছে, ধূম্রায়মান নীল গগন,
ঝঞ্ঝা এসেছে ঝাপটিয়া পাখা, ধেয়ে আয় তুই ক্ষীণ পবন!
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
আগা মুরগি লে কে ভাগা
Friday, May 18, 2018, 10:59 AM
[সুর : ‘একদা তুমি প্রিয়ে আমারই এ তরুমূলে’]
একদা তুমি আগা দৌড়ে কে ভাগা মুরগি লেকে।
তোমারে ফেলনু চিনে ওই আননে জমকালো চাপ দাড়ি দেখে॥
কালো জাম খাচ্ছিলে যে সেইদিন সেই গাছে চড়ে
কালো জাম মনে করে ফেললে খেয়ে ভোমরা ধরে।
‘চুঁ করো আওর চাঁ করো ছোড়ে গা নেই,
সব কুছ কালা কালা খা জায়ে গা’ – বললে হেঁকে॥
ভুলো আর টেমি জিমি চেনে যে ওই ঝাঁকড় চুলে,
তোমারে দেখলে পরে তারস্বরে আসে তেড়ে ল্যাজুড় তুলে।
ও-পাড়ার হীরু তোমায় দেখেই পালায় পগার-পারে,
‘রুপিয়া লে আও,’ বলে ধরলে তাহার ছাগলটারে।
দেখিয়াই মটরু মিয়াঁর মুরগি লুকায় ঝোপের আড়ে,
তাই কি ছেলেমেয়ে মুরগি-চোরা বলে ডাকে॥
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
আঁধারে
Friday, May 18, 2018, 5:30 AM
অমানিশায় আসে আঁধার তেপান্তরের মাঠে;
স্তব্ধ ভয়ে পথিক ভাবে,– কেমনে রাত কাটে!
ওই যে ডাকে হুতোম-পেঁচা, বাতাস করে শাঁ শাঁ!
মেঘে ঢাকা অচিন মুলুক; কোথায় রে কার বাসা?
গা ছুঁয়ে যায় কালিয়ে শীতে শূন্য পথের জু জু–
আঁধার ঘোরে জীবন-খেলার নূতন পালা রুজু।
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
অপরূপ সে দুরন্ত
Friday, May 18, 2018, 2:03 AM
ভাব-বিলাসী অপরূপ সে দুরন্ত,
বাঁধন-হারা মন সদা তার উড়ন্ত!
সে ঘুরে বেড়ায় নীল আকাশে।
চাঁদের সাথে মুচকি হাসে,
গুঞ্জরে সে মউ-মক্ষীর গুঞ্জনে,
সে ফুলের সাথে ফোটে, ঝরে পরাগ হয়ে অঙ্গনে।
তার চোখের পলক ভোরের তারায় ঝলে,
ধুমকেতু তার ফুলঝুরি, সে উল্কা হয়ে চলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।
সে প্রথম-ফোটা গোলাপ-কুঁড়ির সনে–
হিঙুল হয়ে ওঠে লাজে হঠাৎ অকারণে।
ধরা তারে ধরতে নারে ঘরের প্রদীপ দিয়ে,
সে শিশির হয়ে কাঁদে, খেলে পাখির পালক নিয়ে।
সে ঝড়ের সাথে হাসে
সে সাগর-স্রোতে ভাসে,
সে উদাস মনে বসে থাকে জংলা পথের পাশে
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
সে বৃষ্টিধারার সাথে পড়ে গলে,
অস্ত-রবির আড়াল টেনে লুকায় গগন-তলে।
দীপ্ত রবির মুকুরে সে আপন ছায়া দেখে,
সে পথে যেতে যায় যেন কি মায়ার মোহ এঁকে।
ঝরা তারার তির হানে সে নিশুত রাতের নভে,
ঘুমন্তরে জাগিয়ে সে দেয় বিপুল বজ্র-রবে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
সে রঙিন প্রজাপতি
কভু ফুলের দিকে মতি
কভু ভুলের দিকে গতি
তার রুধির-ধারা নদীর স্রোতের মতো
দেহের কূলে বদ্ধ তবু মুক্ত অবিরত।
রূপকে বলে সঙ্গিনী সে, প্রেমকে বলে প্রিয়া,
রূপ ঘুমালে ঊর্ধ্বে ওঠে আত্মাতে প্রেম নিয়া।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।
মরণকে সে ভয় করে না, জ্ঞানীর সভায় ভয়,–
ভাবের সাথে ভাব করে সে অভাব করে জয়।
তার তরল হাসি সরল ভাবে মুগ্ধ সবার মন,
মন ভরে না জ্ঞানীর, করে অর্থ অন্বেষণ।
চোখ আছে যার, তারই চোখের পাতা টিপে ধরে,
হাতিশালায় যায় না, যায় ফুল ফোটে যে-ঘরে।
তার পথের পথিক সাথি,
তার বন্ধু নীরব রাতি,
খ্যাতির খাতায় চায় না চাঁদা, চাঁদের সাথে খেলে,
সে কথা কহে, মুক্ত-পাখা পাখির দেখা পেলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
তারে জ্ঞান-বিলাসী ডাকে না, তায় গাঁয়ের চাষি ডাকে,
তৃষার জলের পাত্র-সম জড়িয়ে ধরে তাকে।
সে রয় না আন্দোলনে,
যেথা আনন্দ হয় আন্দোলিত যায় সে গোপন বনে।
সে চাঁদের আলো, বর্ষা-মেঘের জল,
আপনার খুশিতে ঝরে আপনি সে চঞ্চল।
সে চায় না ফুলের মালা, সে ফুলের মধু চায়,
সে চায় না তাহার নাম,
দান দিয়ে সে পালিয়ে বেড়ায়
চায় না তাহার দাম।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!
কেউ যদি তায় ভালো বলে, আলোর বুকে হয় সে লয়,
বলে, ‘ওগো সুন্দর মোর, তোমায় বলে, আমায় নয়!’
ছন্দ তাহার স্বচ্ছন্দ, দ্বন্দ্ব মাঝে রয় না সে,
যে বড়ো তাঁর সুনাম নিয়ে ক্ষুদ্র কথা কয় না সে।
তার মন্দ শোনার নাইকো সময়,
রসের সাথে নিত্য প্রলয়,
তারে নিন্দা দিলে চন্দন দেয়
সে নন্দন-জাদুকর,
সুন্দর সে, তাই দেখে না কাহারেও সে অসুন্দর।
তারে লোভ দেখিয়ে যায় না ধরা,
আপনাকে যে দিতে চায়–
প্রেম-ভিক্ষু দুরন্ত সে লুটিয়ে পড়ে তাহার পায়।
পূর্ণের সে প্রতিচ্ছায়া, অপরূপ সে দুরন্ত,
মন কাঁদে মোর তারই তরে, মন সদা যার উড়ন্ত!
(ঝড় কাব্যগ্রন্থ)
হোঁদলকুতকুতের বিজ্ঞাপন
---------------------------------------------
পিলে-পটকা
Thursday, May 17, 2018, 6:58 PM
উটমুখো সে সুঁটকো হাশিম,
পেট যেন ঠিক ভুঁটকো কাছিম!
চুলগুলো সব বাবুই দড়ি –
ঘুসকো জ্বরের কাবুয় পড়ি!
তিন-কোনা ইয়া মস্ত মাথা,
ফ্যাচকা-চোখো; হস্ত? হাঁ তা
ঠিক গরিলা, লোবনে ঢ্যাঙা!
নিটপিটে ঠ্যাং সজনে ঠ্যাঙা!
গাইতি-দেঁতো, উঁচকে কপাল
আঁতকে ওঠেন পুঁচকে গোপাল!
নাক খাঁদা ঠিক চামচিকেটি!
আর হাসি? দাঁত খামচি সেটি!
পাঁচের মতন থুতনো ব্যাঁকা!
রগঢিলে, হুঁ ভূতনো ন্যাকা!
কান দুটো টান – ঠিক সে কুলো!
তোবড়ানো গাল, টিকটা ছুলো!
বগলা প্রমাণ ঘাড়টি সরু,
চেঁচান যেন ষাঁড় কী গোরু!
চলেন গিজাং উরর কোলা ব্যাং,
তালপাতা তাঁর ক্ষুর-ওলা ঠ্যাং!
বদরাগি তায় এক-খেয়ালি
বাস রে! খেঁকি খ্যাঁক-শেয়ালি!
ফ্যাঁচকা-মাতু, ছিঁচকাঁদুনে,
কয় লোকে তাই মিচকা টুনে!
জগন্নাথী ঠুঁটো নুলো,
লোম গায়ে ঠিক খুঁটোগুলো!
ল্যাবেন্ডিসি নড়বড়ে চাল,
তুবড়ি মুখে চড়বড়ে গাল!
গুজুর-ঘুণে, দেড়-পাঁজুরে,
ল্যাডাগ্যাপচার, ন্যাড়-নেজুড়ে!
বসেন সে হাড়-ভাঙা ‘দ’,
চেহারা দেখেই সব মামা ‘থ’!
গিরগিটে তার ক্যাঁকলেসে ঢং
দেখলে কবে, ‘ধেত, এ যে সং!’
খ্যাঙরা-কাটি আঙলাগুলো,
কুঁদিলে শ্রীমুখ বাংলা চুলো!
পেটফুলো ইয়া মস্ত পিলে,
দৈবাতে তায় হস্ত দিলে
জোর চটিতং, বিটকেলে চাঁই!
ইঁট খাবে নাকো সিঁটকেলে ভাই!
নাক বেয়ে তার ঝরচে সিয়ান,
ময়রা যেমন করছে ভিয়ান!
স্বপন দেখেন হালকা নিঁদে –
কুইনাইন আর কালকাসিঁদে!
বদন সদাই তোলো হাঁড়ি,
গুড়ামুড়ি খান ষোলো আড়ি!
ঠোকরে সবাই ন্যাড়া মাথায় –
শিলাবিষ্টি ছেঁড়া ছাতায়!
রাক্ষুসে ভাত গিলতে পারে
বাপ রে, বিড়াল ডিঙতে নারে!
হন না ভুলেও ঘরের বাহির,
কাঁথার ভিতর জ্বরের জাহির!
পড়বে কি আর, দূর ভূত ছাই,
ওষুধ খেতেই ফুরসত নাই!
বুঝলে? যত মোটকা মিলে
বাগাও দেখি পটকা পিলে!
বাজবে পেটে তাল ভটাভট
নাক ধিনাধিন গাল ফটাফট!
ঢাকডুবাডুব ইড়িং-বিড়িং
নাচবে ফড়িং তিড়িং তিড়িং!
চুপসো গালে গাব গুবাগুব
গুপি-যন্তর বাজবে বাঃ খুব!
দিব্যি বসে মারবে মাছি,
কাশবে এবং হাঁচবে হাঁচি!
কিলবিলিয়ে দুটো ঠ্যাং
নড়বে যেমন ঠুঁটো ব্যাং!!
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
দিদির বে-তে খোকা
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
‘সাত ভাই চম্পা জাগো’ –
পারুলদি ডাকল, না গো?
একী ভাই, কাঁদচ? – মা গো
কী যে কয় – আরে দুত্তুর!
পারায়ে সপ্ত-সাগর
এসেছে সেই চেনা-বর?
কাহিনির দেশেতে ঘর
তোর সেই রাজপুত্তুর?
মনে হয়, মণ্ডা মেঠাই
খেয়ে জোর আয়েশ মিটাই! –
ভালো ছাই লগাছে না ভাই,
যাবি তুই একেলাটি!
দিদি, তুই সেথায় গিয়ে
যদি ভাই যাস ঘুমিয়ে,
জাগাব পরশ দিয়ে
রেখে যাস সোনার কাঠি।
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
ঠ্যাং-ফুলি
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
হো-হো-হো উররো হো-হো!
হো-হো-হো উররো হো-হো
উররো হো-হো
বাস কী মজা!
কে শুয়ে চুপ সে ভুঁয়ে,
নারছে হাতে পাশ কী সোজা!
হো-বাবা! ঠ্যাং ফুলো যে!
হাসে জোর ব্যাংগুলো সে
ড্যাং তুলো তার
ঠ্যাংটি দেখে!
ন্যাং ন্যাং য়্যাগগোদা ঠ্যাং
আঁতকে ওঠায় ডানপিটেকে!
এক ঠ্যাং তালপাতা তার
যেন বাঁট হালকা ছাতার!
আর পাটা তার
ভিটরে ডাগর!
যেন বাপ! গোবদা গো-সাপ
পেট-ফুলো হুস এক অজাগর!
মোদোটার পিসশাশুড়ি
গোদ-ঠ্যাং চিপসে বুড়ি
বিশ্ব জুড়ি
খিসসা যাহার!
ঠে-ঠে ঠ্যাং নাক ডেঙা ডেং
এই মেয়ে কি শিষ্যা তাহার?
হাদে দেখ আসছে তেড়ে
গোদা-ঠ্যাং ছাঁতসে নেড়ে,
হাসছে বেড়ে
বউদি দেখে!
অ ফুলি! তুই যে শুলি
দ্যাখ না গিয়ে চৌদিকে কে!
বটু তুই জোর দে ভোঁ দৌড়,
রাখালে! ভাঙবে গোঁ তোর
নাদনা গুঁতোর
ভিটিম ভাটিম!
ধুমাধুম তাল ধুমাধুম
পৃষ্ঠে, - মাথায় চাটিম চাটিম!
‘ইতু’ মুখ ভ্যাংচে বলে –
গোদা ঠ্যাং ন্যাংচে চলে
ব্যাং ছা যেন
ইড়িং বিড়িং!
রাগে ওর ঠ্যাং নড়ে জোর
য়্যাদ্দেখেছিস – তিড়িং তিড়িং!
মলিনা! অ খুকুনি!
মা গো! কী ধুকপুকুনি
হাড়-শুগুনি
ভয়-তরাসে!
দেখে ইস ভয়েই মরিস
ন্যাংনুলোটার পাঁইতারাকে।
গোদা-ঠ্যাং পুঁচকে মেয়ে
আসে জোর উঁচকে ধেয়ে
কুঁচকে কপাল,
ইস কী রগড়!
লেলিয়ে দে ঢেলিয়ে!
ফোঁস করে ফের! বিষ কী জবর!
ইন্দু! দৌড়ে যা না!
হাসি, তুই বগ দেখা না!
দগ্ধে না!
তোল তাতিয়ে!
রেণু! বাস, রেগেই ঠ্যাঙাস,
বউদি আসুন বোলতা নিয়ে!
আর না খাপচি খেলো!
ওলো এ আচ্ছি যে লো,
নাচছি তো খুব
ঠ্যাং নিয়ে ওর!
ব্যাচারির হ্যাঁস-ফ্যাসানির
শেষ নেই, মুখ ভ্যাংচিয়ে জোর!
ধ্যাত! পা পিছলে যে সে
পড়ে তার বিষ লেগেছে
ইস! পেকেছে
বিষ-ফোঁড়া এক!
সে ব্যথায় ঠ্যাং ফুলে তাই
ঢাক হল পা-র পিঠ জোড়া দেখ!
আচ্ছু! সত্যি সে শোন
কারুর এক রত্তি সে বোন,
দোষ নেই এতে
দোষ নিয়ো না!
আগে তোর ঠ্যাং ফুলে জোর,
তারপরে না দস্যিপনা!
আয় ভাই আর না আড়ি,
ভাব কর কান্না ছাড়ি,
ঘাড় না নাড়ি,
কসনে ‘উহুঁ’!
লক্ষ্মী! ধ্যাত, শোক কী?
ছিঁচ-কাঁদুনে হসনে হুঁ হুঁ!
উষাদের ঘর যাবিনে?
লাগে তোর লজ্জা দিনে?
বজ্জাতি নে
রাখ তুলে লো!
কেন? ঠ্যাং তেড়েং বেড়েং?
হাসবে লোকে? বয়েই গেল!
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
চিঠি
Thursday, May 17, 2018, 10:13 PM
[ছন্দ :- “এই পথটা কা-টবো
পাথর ফেলে মা-রবো”]
ছোট্ট বোনটি লক্ষ্মী
ভো ‘জটায়ু পক্ষী’!
য়্যাব্বড়ো তিন ছত্র
পেয়েছি তোর পত্র।
দিইনি চিঠি আগে,
তাইতে কি বোন রাগে?
হচ্ছে যে তোর কষ্ট
বুঝতেছি খুব পষ্ট।
তাইতে সদ্য সদ্য
লিখতেছি এই পদ্য।
দেখলি কী তোর ভাগ্যি!
থামবে এবার রাগ কি?
এবার হতে দিব্যি
এমনি করে লিখবি!
বুঝলি কী রে দুষ্টু
কী যে হলুম তুষ্টু
পেয়ে তোর ওই পত্র –
যদিও তিন ছত্র!
যদিও তোর অক্ষর
হাত পা যেন যক্ষর,
পেটটা কারুর চিপসে,
পিঠটে কারুর ঢিপসে,
ঠ্যাংটা কারুর লম্বা,
কেউ বা দেখতে রম্ভা!
কেউ যেন ঠিক থাম্বা,
কেউ বা ডাকেন হাম্বা!
থুতনো কারুর উচ্চে,
কেউ বা ঝুলেন পুচ্ছে!
এক একটা যা বানান
হাঁ করে কী জানান!
কারুর গা ঠিক উচ্ছের,
লিখলি এমনি গুচ্ছের!
না বোন, লক্ষ্মী, বুঝছ?
করব না আর কুচ্ছো!
নইলে দিয়ে লম্ফ
আনবি ভূমিকম্প!
কে বলে যে তুচ্ছ!
ওই যে আঙুর গুচ্ছ!
শিখিয়ে দিল কোন্ ঝি
নামটি যে তোর জন্টি?
লিখবে এবার লক্ষ্মী
নাম ‘জটায়ু পক্ষী!’
শিগগির আমি যাচ্চি,
তুই বুলি আর আচ্ছি
রাখবি শিখে সব গান
নয় ঠেঙিয়ে – অজ্ঞান!
এখনও কি আচ্ছু
খাচ্ছে জ্বরে খাপচু?
ভাঙেনি বউদির ঠ্যাংটা।
রাখালু কি ন্যাংটা?
বলিস তাকে, রাখালী!
সুখে রাখুন মা কালী!
বৌদিরে কোস দোত্তি
ধরবে এবার সত্যি।
গপাস করে গিলবে
য়্যাব্বড়ো দাঁত হিলবে!
মা মাসিমায় পেন্নাম
এখান হতেই করলাম!
স্নেহাশিস এক বস্তা,
পাঠাই, তোরা লস তা!
সাঙ্গ পদ্য সবিটা?
ইতি। তোদের কবি-দা।
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
খোকার বুদ্ধি
Thursday, May 17, 2018, 7:19 PM
চুন করে মুখ প্রাচীর পরে বসে শ্রীযুত খোকা,
কেননা তার মা বলেছেন সে এক নিরেট বোকা।
ডানপিটে সে খোকা এখন মস্ত একটা বীর,
হুংকারে তাঁর হাঁস মুরগির ছানার চক্ষুস্থির!
সাত লাঠিতে ফড়িং মারেন এমনই পালোয়ান!
দাঁত দিয়ে সে ছিঁড়লে সেদিন আস্ত আলোয়ান!
ন্যাংটা-পুঁটো দিগম্বরের দলে তিনিই রাজা,
তাঁরে কিনা বোকা বলা? কী এর উচিত সাজা?
ভাবতে ভাবতে খোকার হঠাৎ চিন্তা গেল থেমে,
দে দৌড় চোঁ-চাঁ আঁধমহলে পাঁচিল হতে নেমে!
বুকের ভেতর ছপাই নপাই ধুকপুকুনির চোটে,
বাইরে কিন্তু চতুর খোকা ঘাবড়ালেন না মোটে।
হাঁপিয়ে এসে মায়ের কাছে বললে, “ওগো মা!
আমি নাকি বোক-চন্দর? বুদ্ধি দেখে যা!
ওই না একটা মটকু বানর দিব্যি মাচায় বসে
লাউ খাচ্ছে? কেউ দেখেনি, দেখি আমিই তো সে।
দিদিদেরও চোখ ছিল তো, কেউ কি দেখেছেন?
তবে আমায় বোকা কও যে! এ্যাঁ-এ্যাঁ, হাস ক্যান্?
কী কও? ‘একী বুদ্ধি হল?’ দেখবে তবে? হাঁ,
বুদ্ধি আমার … ভোলা! তু-উ-উ! লৌ-হা হা-হা-হা!”
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
খোকার গপ্প বলা
Thursday, May 17, 2018, 6:03 PM
মা ডেকে কন, ‘খোকন-মণি! গপ্প তুমি জানো?
কও তো দেখি বাপ!’
কাঁথার বাহির হয়ে তখন জোর দিয়ে এক লাফ
বললে খোকন, ‘গপপ জানি, জানি আমি গানও!’
বলেই খুদে তানসেন সে তান জুড়ে জোর দিল –
‘একদা এক হাড়ের গলায় বাঘ ফুটিয়াছিল!’
মা সে হেসে তখন
বলেন, ‘উহুঁ, গান না, তুমি গপ্প বলো খোকন!’
ন্যাংটা শ্রীযুত খোকা তখন জোর গম্ভীর চালে
সটান কেদারাতে শুয়ে বলেন, “সত্যিকালে
এক যে ছিল রাজা আর মা এক যে ছিল রানি,
হাঁ মা আমি জানি,
মায়ে পোয়ে থাকত তারা,
ঠিক যেন ওই গোঁদলপাড়ার জুজুবুড়ির পারা!
একদিন না রাজা –
ফড়িং শিকার করতে গেলেন খেয়ে পাঁপড়ভাজা!
রানি গেলেন তুলতে কলমি শাক
বাজিয়ে বগল টাক ডুমাডুম টাক!
রাজা শেষে ফিরে এলেন ঘরে
হাতির মতন একটা বেড়াল-বাচ্চা শিকার করে।
এসে রাজা দেখেন কিনা বাপ!
রাজবাড়িতে আগড় দেওয়া, রানি কোথায় গাপ!
দুটোয় গিয়ে এলেন রাজা সতরোটার সে সময়!
বলো তো মা-মণি তুমি, খিদে কি তায় কম হয়?
টাটি-দেওয়া রাজবাড়িতে ওগো,
পান্তাভাত কে বেড়ে দেবে?
খিদের জ্বালায় ভোগো!
ভুলুর মতন দাঁত খিঁচিয়ে বলেন তখন রাজা,
নাদনা দিয়ে জরুর রানির ভাঙা চাই-ই মাজা।
এমন সময় দেখেন রাজা আসচে রানি দৌড়ে
সারকুঁড় হতে ক্যাঁকড়া ধরে রাম-ছাগলে চড়ে!
দেখেই রাজা দাদার মতন খিচমিচিয়ে উঠে –”
‘হাঁরে পুঁটে!’
বলেই খোকার শ্রীযুত দাদা সটান
দুইটি কানে ধরে খোকার চড় কসালেন পটাম্।
বলেন, ‘হাঁদা! ক্যাবলাকান্ত! চাষাড়ে।
গপ্প করতে ঠাঁই পাওনি চণ্ডুখুড়ি আষাঢ়ে?
দেব নাকি ঠ্যাংটা ধরে আছাড়ে?
কাঁদেন আবার! মারব এমন থাপড়,
যে কেঁদে তোমার পেটটি হবে কামার শালার হাপর!’
চড় চাপড় আর কিলে,
ভ্যাবাচ্যাকা খোকামণির চমকে গেল পিলে!
সেদিনকারের গপ্প বলার হয়ে গেল রফা,
খানিক কিন্তু ভেড়ার ভ্যাঁ ডাক শুনেছিলুম তোফা!
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
------------------------------
খোকার খুশি
Thursday, May 17, 2018, 6:03 PM
কী যে ছাই ধানাই-পানাই –
সারাদিন বাজছে সানাই,
এদিকে কারুর গা নাই
আজই না মামার বিয়ে!
বিবাহ! বাস, কী মজা!
সারাদিন মণ্ডা গজা
গপাগপ খাও না সোজা
দেয়ালে ঠেসান দিয়ে।
তবু বর হচ্ছিনে ভাই,
বরের কী মুশকিলটাই –
সারাদিন উপোস মশাই
শুধু খাও হরিমটর!
শোনো ভাই, মোদের যবে
বিবাহ করতে হবে –
‘বিয়ে দাও’ বলব, ‘তবে
কিছুতেই হচ্ছিনে বর!’
সত্যি, কও না মামা,
আমাদের অমনি জামা
অমনি মাথায় ধামা
দেবে না বিয়ে দিয়ে?
মামিমা আসলে এ ঘর
মোদেরও করবে আদর?
বাস, কী মজার খবর!
আমি রোজ করব বিয়ে॥
(ঝিঙেফুল কাব্যগ্রন্থ)
অর্ঘ্য
Friday, May 18, 2018, 10:59 AM
হায় চির-ভোলা! হিমালয় হতে
অমৃত আনিতে গিয়া
ফিরিয়া এলে যে নীলকণ্ঠের
মৃত্যু-গরল পিয়া!
কেন এত ভালো বেসেছিলে তুমি
এই ধরণির ধূলি?
দেবতারা তাই দামামা বাজায়ে
স্বর্গে লইল তুলি!
হুগলি
৩রা আষাঢ়, ১৩৩২
(চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ)
অকাল-সন্ধ্যা
Friday, May 18, 2018, 1:40 AM
অকাল-সন্ধ্যা
[জয়জয়ন্তী কীর্তন]
খোলো মা দুয়ার খোলো
প্রভাতেই সন্ধ্যা হল
দুপুরেই ডুবল দিবাকর গো।
সমরে শয়ান ওই
সুত তোর বিশ্বজয়ী
কাঁদনের উঠছে তুফান ঝড় গো॥
সবারে বিলিয়ে সুধা,
সে নিল মৃত্যু-ক্ষুধা,
কুসুম ফেলে নিল খঞ্জর গো।
তাহারই অস্থি চিরে
দেবতা বজ্র গড়ে
নাশে ওই অসুর অসুন্দর গো।
ওই মা যায় সে হেসে।
দেবতার উপরে সে,
ধরা নয়, স্বর্গ তাহার ঘর গো॥
যাও বীর যাও গো চলে
চরণে মরণ দলে
করুক প্রণাম বিশ্ব-চরাচর গো।
তোমার ওই চিত্ত জ্বেলে
ভাঙ্গালে ঘুম ভাঙ্গালে
নিজে হায় নিবলে চিতার পর গো।
বেদনার শ্মশান-দহে
পুড়ালে আপন দেহে,
হেথা কি নাচবে না শংকর গো॥
আরিয়াদহ
৬ আষাঢ়, ১৩৩২
(চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থ)
সুবহ্-উম্মেদ
Thursday, May 17, 2018, 11:49 PM
সর্বনাশের পরে পৌষ মাস
এল কি আবার ইসলামের?
মন্বন্তর-অন্তে কে দিল
ধরণিরে ধন-ধান্য ঢের?
ভুখারির রোজা রমজান পরে
এল কি ঈদের নওরোজা?
এল কি আরব-আহবে আবার
মূর্ত মর্ত-মোর্তজা?
হিজরত করে হজরত কি রে
এল এ মেদিনী-মদিনা ফের?
নতুন করিয়া হিজরি গণনা
হবে কি আবার মুসলিমের?
* * *
বরদ-বিজয়ী বদরুদ্দোজা৪
ঘুচাল কি অমা রৌশনিতে?
সিজাদ করিল নিজ্দ হেজাজ৬
আবার ‘কাবা’র মসজিদে।
আরবে করিল ‘দারুল-হার’–
ধসে পড়ে বুঝি ‘কাবা’র ছাদ!
‘দীন দীন’রবে শমশের-হাতে
ছুটে শের-নর ‘ইবনে সাদ’!
মাজার ফাড়িয়া উঠিল হাজার
জিন্দান-ভাঙা জিন্দা বীর!
গারত হইল করদ হুসেন,
উঁচু হল পুন শির নবির!
আরব আবার হল আরাস্তা,
বান্দারা যত পড়ে দরুদ।
পড়ে শুকরানা‘আরবা রেকাত’
আরফাতে যত স্বর্গ-দূত।
ঘোষিল ওহদ, ‘আল্লা আহদ !’
ফুকারে তূর্য তুর পাহাড়
মন্দ্রে বিশ্ব-রন্ধ্রে-রন্ধ্রে
মন্ত্র আল্লা-হু-আকবার!
জাগিয়া শুনিনু প্রভাতি আজান
দিতেছে নবীন মোয়াজ্জিন।
মনে হল এল ভক্ত বেলাল
রক্ত এ-দিনে জাগাতে দীন!
জেগেছে তখন তরুণ তুরাণ
গোর চিরে যেন আঙ্গোরায়।
গ্রিসের গরুরী গারত করিয়া
বোঁও বোঁও তলোয়ার ঘোরায়।
রংরেজ৭ যেন শমশের যত
লালফেজ-শিরে তুর্কিদের।
লালে-লাল করে কৃষ্ণসাগর
রক্ত-প্রবাল চূর্ণি ফের।
মোতি হার সম হাথিয়ার দোলে
তরুণ তুরাণি বুকে পিঠে!
খাট্টা-মেজাজ গাঁট্টা মারিছে
দেশ-শত্রুর গিঁঠে গিঁঠে!
মুক্ত চন্দ্র-লাঞ্ছিত ধ্বজা
পতপত ওড়ে তুর্কিতে,
রঙিন আজি ম্লান আস্তানা
সুরখ রঙের সুর্খিতে
বিরান১০ মুলুক ইরানও সহসা
জাগিয়াছে দেখি ত্যজিয়া নিদ!
মাশুকের বাহু ছাড়ায়ে আশিক
কসম করিছে হবে শহিদ!
লায়লির প্রেমে মজনুন আজি
‘লা-এলা’র তরে ধরেছে তেগ।
শিরীন শিরীরে ভুলে ফরহাদ
সারা ইসলাম পরে আশেক!
পেশতা-আপেল-আনার-আঙুর-
নারঙ্গি-শেব-বোস্তানে
মুলতুবি আজ সাকি ও শরাব
দীওয়ান-ই-হাফিজ জুজদানে!
নার্গিস লালা লালে-লাল আজি
তাজা খুন মেখে বীর প্রাণের,
ফিরদৌসীর রণ-দুন্দুভি
শুনে পিঞ্জরে জেগেছে শের!
হিংসায়-সিয়া শিয়াদের তাজে
শিরাজী-শোণিমা লেগেছে আজ।
নৌ-রুস্তম উঠেছে রুখিয়া
সফেদ দানবে দিয়াছে লাজ?
মরা মরক্কো মরিয়া হইয়া
মাতিয়াছে করি মরণ-পণ,
স্তম্ভিত হয়ে হেরিছে বিশ্ব–
আজও মুসলিম ভোলেনি রণ!
জ্বালাবে আবার খেদিব-প্রদীপ
গাজি আবদুল করিম বীর,
দ্বিতীয় কামাল রীফ-সর্দার–
স্পেন ভয়ে পায়ে নোয়ায় শির!
রীফ৬ শরিফ সে কতটুকু ঠাঁই
আজ তারই কথা ভুবনময়!–
মৃত্যুর মাঝে মৃত্যুঞ্জয়ে
দেখেছে যাহারা, তাদেরই জয়!
মেষ-সম যারা ছিল এতদিন
শের হল আজ সেই মেসের!
এ-মেষের দেশ মেষ-ই রহিল
কাফ্রির অধম এরা কাফের!
নীল দরিয়ায় জেগেছে জোয়ার
‘মুসা’র উষার টুটেছে ঘুম।
অভিশাপ-‘আসা’ গর্জিয়া আসে
গ্রাসিবে যন্ত্রী-জাদু-জুলুম।
ফেরাউন১ আজও মরেনি ডুবিয়া?
দেরি নাই তার, ডুবিবে কাল!
জালিম-রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে
জ্বলেছে খোদার লাল মশাল!
কাবুল লইল নতুন দীক্ষা
কবুল করিল আপনা জান।
পাহাড়ি তরুর শুকনো শাখায়
গাহে বুলবুল খোশ এলহান!
পামির ছাড়িয়া আমির আজিকে
পথের ধুলায় খোঁজে মণি!
মিলিয়াছে মরা মরু-সাগরে রে
আব-হায়াতের৩ প্রাণ-খনি!
খর-রোদ-পোড়া খর্জুর তরু–
তারও বুক ফেটে ক্ষরিছে ক্ষীর!
“সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামলা”
ভারতের বুকে নাই রুধির!
জাগিল আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।–
সর্বনাশের পরে পৌষমাস
এলো কি আবার ইসলামের?
* * *
কসাই-খানার সাত কোটি মেষ
ইহাদেরই শুধু নাই কি ত্রাণ
মার খেয়ে খেয়ে মরিয়া হইয়া
উঠিতে এদের নাই প্রাণ?
জেগেছে আরব ইরান তুরান
মরক্কো আফগান মেসের।
এয়্ খোদা! এই জাগরণ-রোলে
এ-মেষের দেশও জাগাও ফের!
হুগলি,
অগ্রহায়ণ, ১৩৩১
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
বার্ষিক সওগাত
Friday, May 18, 2018, 3:23 AM
বন্ধু গো সাকি আনিয়াছ নাকি বরষের সওগাত –
দীর্ঘ দিনের বিরহের পরে প্রিয়-মিলনের রাত।
রঙিন রাখি, শিরীন শারাব, মুরলী, রবাব, বীণ,
গুলিস্তানের বুলবুল পাখি, সোনালি রুপালি দিন।
লালা-ফুল সম দাগ-খাওয়া দিল, নার্গিস-ফুলি আঁখ,
ইস্পাহানির হেনা-মাখা হাত, পাতলি কাঁখ!
নৈশাপুরের গুলবদনির চিবুক গালের টোল,
রাঙা লেড়কির ভাঙা ভাঙা হাসি, শিরীন শিরীন বোল।
সুরমা-কাজল স্তাম্বুলি চোখ, বসোরা গুলের লালি,
নব বোগাদাদি আলিফ-লায়লা, শাজাদি জুলফ-ওয়ালি।
পাকা খর্জুর, ডাঁশা আঙ্গুর, টোকো-মিঠে কিসমিস,
মরু-মঞ্জীর আব-জমজম,যবের ফিরোজা শিস।
আশা-ভরা মুখ,তাজা তাজা বুক, নৌ-জোয়ানির গান,
দুঃসাহসীর মরণ-সাধনা, জেহাদের অভিযান।
আরবের প্রাণ, ফারেসের বাজু নৌ-তুর্কির,
দারাজ দিলীর আফগানি দিল, মূরের জখমি শির।
নীল দরিয়ায় মেসেরের আঁসু, ইরাকের টুটা তখ্ত,
বন্দী শামের জিন্দান-খানা, হিন্দের বদবখ্ত! –
তাঞ্জাম-ভরা আঞ্জাম এ যে কিছুই রাখনি বাকি,
পুরানো দিনের হাতে বাঁধিয়াছ নতুন দিনের রাখি।…
চোখের পানির ঝালর-ঝুলানো হাসির খাঞ্চাপোশ
– যেন অশ্রুর গড়খাই-ঘেরা দিল্খোস ফেরদৌস –
ঢাকিয়ো বন্ধু তব সওগাতি-রেকাবি তাহাই দিয়ে,
দিবসের জ্বালা ভুলে যেতে চাই রাতের শিশির পিয়ে !
বেদনার বানে সয়লাব সব, পাইনে সাথির হাত,
আনো গো বন্ধু নূহের কিশতি– ‘বার্ষিকী সওগাত!’
[কৃষ্ণনগর
২৫ অগ্রহায়ণ,১৩৩৩]
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
নাকিব
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
নব-জীবনের নব-উত্থান-আজান ফুকারি এসো নকিব।
জাগাও জড়! জাগাও জীব!
জাগে দুর্বল, জাগে ক্ষুধা-ক্ষীণ,
জাগিছে কৃষাণ ধুলায়-মলিন,
জাগে গৃহহীন, জাগে পরাধীন
জাগে মজলুম বদ-নসিব!
মিনারে মিনারে বাজে আহ্বান –
‘আজ জীবনের নব উত্থান!’
শঙ্কাহরণ জাগিছে জোয়ান
জাগে বলহীন জাগিছে ক্লীব,
নব জীবনের নব উত্থান –
আজান ফুকারি এসো নকিব!
হুগলি,
১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৩২
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
জীবন
Thursday, May 17, 2018, 5:29 PM
জাগরণের লাগল ছোঁয়াচ মাঠে মাঠে তেপান্তরে,
এমন বাদল ব্যর্থ হবে তন্দ্রাকাতর কাহার ঘরে?
তড়িৎ ত্বরা দেয় ইশারা, বজ্র হেঁকে যায় দরজায়,
জাগে আকাশ, জাগে ধরা−ধরার মানুষ কে সে ঘুমায়?
মাটির নীচে পায়ের তলায় সেদিন যারা ছিল মরি,
শ্যামল তৃণাঙ্কুরে তারা উঠল বেঁচে নতুন করি;
সবুজ ধরা দেখছে স্বপন আসবে কখন ফাগুন-হোলি,
বজ্রাঘাতে ফুটল না যে, ফুটবে আনন্দে সে কলি!
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
খোশ আমদেদ
Friday, May 18, 2018, 1:19 AM
আসিলে কে গো অতিথি উড়ায়ে নিশান সোনালি।
ও চরণ ছুঁই কেমন হাতে মোর মাখা যে কালি॥
দখিনের হালকা হাওয়ায় আসলে ভেসে সুদূর বরাতি
শবে-রাত আজ উজালা গো আঙিনায় জ্বলল দীপালি॥
তালিবান ঝুমকি বাজায়, গায় মোবারক-বাদ৪ কোয়েলা।
উলসি উপচে পলো পলাশ অশোক ডালের ওই ডালি॥
প্রাচীন ওই বটের ঝুরির দোলনাতে হায় দুলিছে শিশু।
ভাঙা ওই দেউল-চূড়ে উঠল বুঝি নৌ-চাঁদের ফালি॥
এল কি অলখ-আকাশ বেয়ে তরুণ হারুণ-আল-রশীদ।
এল কি আল-বেরুনি হাফিজ খৈয়াম কায়েস গাজ্জালি৫॥
সানাইয়াঁ ভয়রোঁ বাজায়, নিদ-মহলায় জাগল শাহজাদি।
কারুণের রুপার পুরে নূপুর-পায়ে আসল রূপ-ওয়ালি।
খুশির এ বুলবুলিস্তানে মিলেছে ফরহাদ ও শিরীঁ।
লাল এ লায়লি লোকে মজনুঁ হরদম চালায় পেয়ালি॥
বাসি ফুল কুড়িয়ে মালা না-ই গাঁথিলি, রে ফুল-মালি!
নবীনের আসার পথে উজাড় করে দে ফুল ডালি॥
পদ্মা
২৭.২.২৭
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
খালেদ
Friday, May 18, 2018, 3:26 AM
খালেদ! খালেদ! শুনিতেছে নাকি সাহারার আহা-জারি?
কত ‘ওয়েসিস’ রচিল তাহার মরু-নয়নের বারি।
মরীচিকা তার সন্ধানী-আলো দিকে দিকে ফেরে খুঁজি
কোন নিরালায় ক্লান্ত সেনানী ডেরা গাড়িয়াছ বুঝি!
বালু-বোররাকে সওয়ার হইয়া ডাক দিয়া ফেরে ‘লু’,
তব তরে হায়! পথে রেখে যায় মৃগীরা মেশক-বু!
খর্জুর-বীথি আজিও ওড়ায় তোমার জয়ধ্বজা,
তোমার আশায় বেদুইন-বালা আজিও রাখিছে রোজা।
‘মোতাকারিব’-এর ছন্দে উটের সারি দুলে দুলে চলে,
দু-চোখ তাদের দিশাহারা পথে আলেয়ার মতো জ্বলে।
‘খালেদ! খালেদ!’পথ-মঞ্জিলে ক্লান্ত উটেরা কহে,
“বণিকের বোঝা বহা তো মোদের চিরকেলে পেশা নহে!”
‘সুতুর-বানের’ বাঁশি শুনে উট উল্লাস-ভরে নাচে,
ভাবে, নকিবের বাঁশরির পিছে রণ-দামামাও আছে।
ন্যুব্জ এ পিঠ খাড়া হত তার সওয়ারের নাড়া পেয়ে,
তলওয়ার তির গোর্জ নেজায় পিঠ যেত তার ছেয়ে।
খুন দেখিয়াছে, তূণ বহিয়াছে, নুন বহেনিকো কভু!
* * *
বালু ফেড়ে ওঠে রক্ত-সূর্য ফজরের শেষে দেখি,
দুশমান-খুনে লাল হয়ে ওঠে খালেদি আমামা এ কী!
খালেদ! খালেদ! ভাঙিবে নাকি ও হাজার বছরি ঘুম?
মাজার ধরিয়া ফরিয়াদ করে বিশ্বের মজলুম!–
শহিদ হয়েছ? ওফাত হয়েছে? ঝুটবাত! আলবত!
খালেদের জান কব্জ করিবে ওই মালেকুল-মৌত?
বছর গিয়াছে গেছে শতাব্দী যুগযুগান্ত কত,
জালিম৯ পারসি রোমক রাজার জুলুম সে শত শত
রাজ্য ও দেশ গেছে ছারেখারে! দুর্বল নরনারী
কোটি কোটি প্রাণ দিয়াছে নিত্য কত্ল-গাহেতে তারই!
উৎপীড়িতের লোনা আঁসু-জলে গলে গেল কত কাবা,
কত উজ তাতে ডুবে মলো হায়, কত নূহ্ হল তাবা!
সেদিন তোমার মালেকুল-মৌত কোথায় আছিল বসি?
কেন সে তখন জালিম রাজার প্রাসাদে প্রাসাদে পশি
বেছে বেছে ওই ‘সঙ্গ্-দিল’দের কব্জ করেনি জান?
মালেকুল-মৌত সেদিনও মেনেছে বাদশাহি ফরমান!–
মক্কার হাতে চাঁদ এল যবে তকদিরে আফতাব
কুল-মখলুক দেখিতে লাগিল শুধু ইসলামি খাব,
শুকনো খবুজ খোর্মা চিবায়ে উমর দারাজ-দিল
ভাবিছে কেমন খুলিবে আরব দিন-দুনিয়ার খিল, –
এমন সময় আসিল জোয়ান হাথেলিতে হাথিয়ার,
খর্জুর-শিষে ঠেকিয়াছে গিয়া উঁচা উষ্ণীয় তার!
কব্জা তাহার সব্জা হয়েছে তলওয়ার-মুঠ ডলে,
দু-চোখ ঝালিয়া আশায় দজ্লা ফোরাত পড়িছে গলে!
বাজুতে তাহার বাঁধা কোর-আন, বুকের দুর্মদ বেগ,
আলবোরজের চূড়া গুঁড়া-করা দস্তে দারুণ তেগ।
নেজার৪ ফলক উল্কার সম উগ্রগতিতে ছোটে,
তির খেয়ে তার আশমান-মুখে তারা-রূপে ফেনা ওঠে।
দারাজ দস্ত যেদিকে বাড়ায় সেইদিক পড়ে ভেঙে,
ভাস্কর-সম যেদিকে তাকায় সেইদিক ওঠে রেঙে!
ওলিদের বেটা খালেদ সে বীর যাহার নামের ত্রাসে
পারস্য-রাজ নীল হয়ে উঠে ঢলে পড়ে সাকি-পাশে!
রোম-সম্রাট শারাবের জাম -হাতে থরথর কাঁপে,
ইস্তাম্বুলি বাদশার যত নজ্জুম আয়ু মাপে!
মজলুম যত মোনাজাত করে কেঁদে কয় “এয়্ খোদা,
খালেদের বাজু-শমশের রেখো সহি-সালামতে সদা।”
আজরাইলও সে পারেনি এগুতে যে আজাজিলের আগে,
ঝুঁটি ধরে তার এনেছে খালেদ, ভেড়ি ধরে যেন বাঘে!
মালেকুল-মৌত করিবে কব্জ রু্হ্ সেই খালেদের?–
হাজার হাজার চামড়া বিছায়ে মাজারে ঘুমায় শের!
খালেদ! খালেদ! ফজর হল যে, আজান দিতেছে কৌম,
ওই শোনো শোনো –”আস্সালাতু খায়র মিনান্নৌম!”
যত সে জালিম রাজা-বাদশারে মাটিতে করেছে গুম
তাহাদেরই সেই খাকেতে খালেদ করিয়া তয়ম্মুখ
বাহিরিয়া এসো, হে রণ-ইমাম, জামায়েত আজ ভারী!
আরব, ইরান, তুর্ক, কাবুল দাঁড়ায়েছে সারি সারি!
আব-জমজম উথলি উঠিছে তোমার ওজুর তরে,
সারা ইসলাম বিনা ইমামেতে আজিকে নামাজ পড়ে!
খালেদ! খালেদ! ফজরে এলে না, জোহরকাটানু কেঁদে,
আসরে ক্লান্ত ঢুলিয়াছি শুধু বৃথা তহ্রিমা বেঁধে!
এবে কাফনের খেলকা পরিয়া চলিয়াছি বেলা-শেষে,
মগ্রেবের আজ নামাজ পড়িব আসিয়া তোমার দেশে!
খালেদ! খালেদ! সত্য বলিব, ঢাকিব না আজ কিছু,
সফেদ দেও আজ বিশ্ববিজয়ী, আমরা হটেছি পিছু!
তোমার ঘোড়ার খুরের দাপটে মরেছে যে পিপীলিকা,
মোরা আজ দেখি জগৎ জুড়িয়া তাহাদেরই বিভীষিকা!
হঠিতে হঠিতে আসিয়া পড়েছি আখেরি গোরস্থানে,
মগ্রেব-বাদে এশার১ নামাজ পাব কিনা কে সে জানে!
খালেদ! খালেদ! বিবস্ত্র মোরা পরেছি কাফন শেষে,
হাথিয়ার-হারা, দাঁড়ায়েছি তাই তহ্রিমা বেঁধে এসে!
ইমামতি তুমি করিবে না জানি, তুমি গাজি মহাবীর,
দিন-দুনিয়ার শহিদ নোয়ায় তোমার কদমে শির!
চারিটি জিনিস চিনেছিলে মতুমি, জানিতে না হের-ফের,
আল্লা, রসুল, ইসলাম আর শের-মারা শমশের!
খিলাফত তুমি চাওনিকো কভু চাহিলে – আমরা জানি, –
তোমার হাতের বে-দেরেগ৩ তেগ অবহেলে দিত আনি!
উমর যেদিন বিনা অজুহাতে পাঠাইল ফরমান, –
“সিপাহ্-সালার খালেদ পাবে না পূর্বের সম্মান,
আমার আদেশ – খালেদ ওলিদ সেনাপতি থাকিবে না,
সাদের অধীনে করিবে যুদ্ধ হয়ে সাধারণ সেনা!”
ঝরা জলপাই-পাতার মতন কাঁপিতে কাঁপিতে সাদ,
দিল ফরমান, নফসি নফসি জপে, গণে পরমাদ!
খালেদ! খালেদ! তাজিমের সাথে ফরমান পড়ে চুমি
সিপাহ-সালারের সকল জেওরখুলিয়া ফেলিলে তুমি।
শিশুর মতন সরল হাসিতে বদন উজালা করি
একে একে সব রেখে দিলে তুমি সাদের চরণ পরি!
বলিলে, “আমি তো সেনাপতি হতে আসিনি, ইবনে সাদ,
সত্যের তরে হইব শহিদ, এই জীবনের সাধ!
উমরের নয়, এ যে খলিফার ফরমান, ছি ছি আমি
লঙ্ঘিয়া তাহা রোজ-কিয়ামতে হব যশ-বদনামি?”
মার মুখো যত সেনাদলে ডেকে ইঙ্গিতে বুঝাইলে,
কুর্নিশ করি সাদেরে, মামুলি সেনাবাসে ডেরা নিলে!
সেনাদের চোখে আঁসু ধরে না কো, হেসে কেঁদে তারা বলে, –
“খালেদ আছিল মাথায় মোদের, এবার আসিল কোলে!”
মক্কায় যবে আসিলে ফিরিয়া, উমর কাঁদিয়া ছুটে,
এ কী রে, খলিফা কাহার বক্ষে কাঁদিয়া পড়িল লুটে!
“খালেদ! খালেদ!” ডাকে আর কাঁদে উমর পাগল-প্রায়
বলে, “সত্যই মহাবীর তুই, বুসা দিই তোকে, আয়!
তখ্তের পর তখ্ত যখন তোমার তেগের আগে
ভাঙিতে লাগিল, হাতুড়ি যেমন বাদামের খোসা ভাঙে, –
ভাবিলাম বুঝি তোমারে এবার মুগ্ধ আরব-বাসী
সিজদা করিবে, বীরপূজা বুঝি আসিল সর্বনাশী!
পরীক্ষা আমি করেছি খালেদ, ক্ষমা চাই ভাই ফের,
আজ হতে তুমি সিপাহ-সালার ইসলাম জগতের!”
খালেদ! খালেদ! কীর্তি তোমার ভুলি নাই মোরা কিছু,
তুমি নাই তাই ইসলাম আজ হটিতেছে শুধু পিছু।
পুরানো দামামা পিটিয়া পিটিয়া ছিঁড়িয়ে গিয়াছে আজ,
আমামা অস্ত্র ছিল নাকো তবু দামামা ঢাকিত লাজ!
দামামা তো আজ ফাঁসিয়া গিয়াছে, লজ্জা কোথায় রাখি,
নামাজ রোজার আড়ালেতে তাই ভীরুতা মোদের ঢাকি!
খালেদ! খালেদ! লুকাব না কিছু, সত্য বলিব আজি,
ত্যাগী ও শহিদ হওয়া ছাড়া মোরা আর সব হতে রাজি!
রীশ-ই বুলন্দ্, শেরওয়ানি, চোগা, তসবি ও টুপি ছাড়া
পড়ে নাকো কিছু, মুসলিম-গাছ ধরে যত দাও নাড়া!
* * *
খালেদ! খালেদ! সবার অধম মোরা হিন্দুস্থানি,
হিন্দু না মোরা মুসলিম তাহা নিজেরাই নাহি জানি!
সকলে শেষে হামাগুড়ি দিই, –না, না, বসে বসে শুধু
মুনাজাত৬করি, চোখের সুমুখে নিরাশা-সাহারা ধুধু!
দাঁড়ায়ে নামাজ পড়িতে পারি না, কোমর গিয়াছে টুটি,
সিজদা করিতে ‘বাবা গো’বলিয়া ধূলিতলে পড়ি লুটি!
পিছন ফিরিয়া দেখি লাল-মুখ আজরাইলের ভাই,
আল্লা ভুলিয়া বলি, “প্রভু মোর তুমি ছাড়া নাই।”
টক্কর খেতে খেতে শেষে এই আসিয়া পড়েছি হেথা,
খালেদ! খালেদ! রি রি করে বুকে পরাধীনতার ব্যথা!
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে আমরা তখনও বসে
বিবি-তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি ফেকা ও হাদিস চষে!
হানফী, ওহাবী, লা-মজহাবীর৯ তখনও মেটেনি গোল,
এমন সময় আজাজিল এসে হাঁকিল, ‘তল্পি তোল!’
ভিতরের দিকে যত মরিয়াছি, বাহিরের দিকে তত
গুনতিতে মোড়া বাড়িয়া চলেছি গোরু ছাগলের মতো!
খালেদ! খালেদ! এই পশুদের চামড়া দিয়ে কি তবে
তোমার পায়ের দুশমন-মারা দুটো পয়জারও হবে?
হায় হায় হায়, কাঁদে সাহারায় আজিও তেমনই ও কে?
দজলা-ফোরাত নতুন করিয়া মাতম করিছে শোকে!
খর্জুর পেকে খোর্মা হইয়া শুকায়ে পড়েছে ঝুরে
আঙুর বেদানা নতুন করিয়া বেদনার রসে পুরে।
এক রাশ শুখো আখরোট আর বাদাম ছাড়াতে লয়ে
আঙুল ছেঁচিয়া মুখ দিয়া চুষে মৌনা আরবি-বউয়ে!
জগতের সেরা আরবের তেজি যুদ্ধ-তাজির চালে
বেদুইন-কবি সংগীত রচি নাচিতেছে তালে তালে!
তেমনই করিয়া কাবার মিনারে চড়িয়া মুয়াজ্জিন
আজানের সুরে বলে, কোনোমতে আজও বেঁচে আছে দ্বীন!
খালেদ! খালেদ! দেখো দেখো ওই জমাতের পিছে কারা
দাঁড়ায়ে রয়েছে, নড়িতে পারে না, আহা রে সর্বহারা!
সকলের পিছে নহে বটে তবু জমাত-শামিল নয়,
উহাদের চোখে হিন্দের মতো নাই বটে নিদ্-ভয়!
পিরানের সব দামন ছিন্ন, কিন্তু সে সম্মুখে
পেরেশান৪ ওরা তবু দেখিতেছি ভাঙিয়া পড়েনি দুখে!
তকদির বেয়ে খুন ঝরে ওই উহারা মেসেরি বুঝি।
টলে তবু চলে বারে বারে হারে বারে বারে ওরা যুঝি।
এক হাতে বাঁধা হেম-জিঞ্জির আর এক হাত খোলা
কী যেন হারামি নেশার আবেশে চক্ষু ওদের ঘোলা!
ও বুঝি ইরাকি? খালেদ! খালেদ! আরে মজা দেখো, ওঠো,
শ্বেত-শয়তান ধরিয়াছে আজ তোমার তেগের মুঠো!
দুহাতে দুপায়ে আড়-বেড়ি দেওয়া ও কারা চলিতে নারে,
চলিতে চাহিলে আপনার ভায়ে পিছন হইতে মারে।
মরদের মতো চেহারা ওদের স্বাধীনের মতো বুলি,
অলস দু-বাজু দু-চোখ সিয়াহ অবিশ্বাসের ঠুলি!
শামবাসী৭ ওরা সহিতে শেখেনি পরাধীনতার চাপ,
তলওয়ার নাই, বহিছে কটিতে কেবল শূন্যে খাপ!
খালেদ! খালেদ! মিসমার হল তোমার ইরাক শাম,
জর্ডন নদে ডুবিয়াছে পাক জেরুজালেমের নাম!
খালেদ! খালেদ! দুধারি তোমার কোথা সেই তলোয়ার?
তুমি ঘুমায়েছ, তলোয়ার তব সে তো নহে ঘুমাবার!
জং ধরেনিকো কখনও তাহাতে জঙ্গের খুনে নেয়ে,
হাথেলিতে তব নাচিয়া ফিরেছে যেন বেদুইন মেয়ে!
খাপে বিরামের অবসর তার মেলেনি জীবনে কভু,
জুলফিকার৩ সে দুখান হয়েছে, ও তেগ টুটেনি তবু।
তুমি নাই তাই মরিয়া গিয়াছে তরবারিও কি তব?
হাত গেছে বলে হাত-যশও গেল? গল্প এ অভিনব!
খালেদ! খালেদ! জিন্দা হয়েছে আবার হিন্দা৪ বুড়ি,
কত হামজারে মারে জাদুকরি, দেশে দেশে ফেরে উড়ি!
ও কারা সহসা পর্বত ভেঙে তুহিন স্রোতের মতো,
শত্রুর শিরে উন্মদবেগে পড়িতেছে অবিরত!
আগুনের দাহে গলিছে তুহিন আবার জমিয়া উঠে,
শির উহাদের ছুটে গেল হায়! তবু নাহি পড়ে টুটে!
ওরা মরক্কো মরদের জাত মৃত্যু মুঠার পরে,
শত্রুর হাতে শির দিয়া ওরা শুধু হাতে পায়ে লড়ে!
খালেদ! খালেদ! সর্দার আর শির পায় যদি মূর
খাসা জুতো তারা করিবে তৈরি খাল দিয়া শত্রুর!
খালেদ! খালেদ! জাজিরাতুল সে আরবের পাক মাটি
পলিদ হইল, খুলেছে এখানে যুরোপ পাপের ভাঁটি!
মওতের দারু পিইলে ভাঙে না হাজার বছরি ঘুম?
খালেদ! খালেদ! মাজার আঁকড়ি কাঁদিতেছে মজলুম।
খোদার হাবিব বলিয়া গেছেন আসিবেন ইসা ফের,
চাই না মেহেদি, তুমি এসো বীর হাতে নিয়ে শমশের।
কৃষ্ণনগর,
২১ অগ্রহায়ণ, ’৩৩
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
অগ্র-পথিক
Friday, May 18, 2018, 9:46 AM
অগ্র-পথিক হে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল।
রৌদ্রদগ্ধ মাটিমাখা শোন ভাইরা মোর,
বসি বসুধায় নব অভিযান আজিকে তোর!
রাখ তৈয়ার হাথেলিতে হাথিয়ার জোয়ান,
হান রে নিশিত পাশুপতাস্ত্র অগ্নিবাণ!
কোথায় হাতুড়ি কোথা শাবল?
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
কোথায় মানিক ভাইরা আমার, সাজ রে সাজ!
আর বিলম্ব সাজে না, চালাও কুচকাওয়াজ!
আমরা নবীন তেজ-প্রদীপ্ত বীর তরুণ
বিপদ বাধার কণ্ঠ ছিঁড়িয়া শুষিব খুন!
আমরা ফলাব ফুল-ফসল।
অগ্র-পথিক রে যুবাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
প্রাণ-চঞ্চল প্রাচী-র তরুণ, কর্মবীর,
হে মানবতার প্রতীক গর্ব উচ্চশির!
দিব্যচক্ষে দেখিতেছি, তোরা দৃপ্তপদ
সকলের আগে চলিবি পারায়ে গিরি ও নদ,
মরু-সঞ্চর গতি-চপল।
অগ্র-পথিক রে পাঁওদল,
জোর কদম চল রে চল॥
স্থবির শ্রান্ত প্রাচী-র প্রাচীন জাতিরা সব
হারায়েছে আজ দীক্ষাদানের সে-গৌরব।
অবনত-শির গতিহীন তারা। মোরা তরুণ
বহিব সে ভার, লব শাশ্বত ব্রত দারুণ
শিখাব নতুন মন্ত্রবল।
রে নব পথিক যাত্রীদল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চলিব পশ্চাতে ফেলি পচা অতীত,
গিরি-গুহা ছাড়ি খোলা প্রান্তরে গাহিব গীত।
সৃজিব জগৎ বিচিত্রতর, বীর্যবান,
তাজা জীবন্ত সে নব সৃষ্টি শ্রম-মহান,
চলমান-বেগে প্রাণ-উছল।
রে নবযুগের স্রষ্টাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
অভিযান-সেনা আমরা ছুটিব দলে দলে
বনে নদীতটে গিরি-সংকটে জলে থলে।
লঙ্ঘিব খাড়া পর্বত-চূড়া অনিমিষে,
জয় করি সব তসনস করি পায়ে পিষে,
অসীম সাহসে ভাঙি আগল!
না জানা পথের নকিব-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
পাতিত করিয়া শুষ্ক বৃদ্ধ অটবিরে
বাঁধ বাঁধি চলি দুস্তর খর স্রোত-নীরে।
রসাতল চিরি হীরকের খনি করি খনন,
কুমারী ধরার গর্ভে করি গো ফুল সৃজন,
পায়ে হেঁটে মাপি ধরণিতল!
অগ্র-পথিক রে চঞ্চল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা এসেছি নবীন প্রাচী-র নবস্রোতে
ভীম পর্বত ক্রকচ-গিরির১ চূড়া হাতে,
উচ্চ অধিত্যকা প্রণালিকা হইয়া বার;
আহত বাঘের পদ-চিন ধরি হয়েছি বার ;
পাতাল ফুঁড়িয়া, পথ-পাগল।
অগ্রবাহিনী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আয়র্ল্যান্ড, আরব, মিশর, কোরিয়া চীন,
নরওয়ে, স্পেন, রাশিয়া, – সবার ধারি গো ঋণ!
সবার রক্তে মোদের লোহুর আভাস পাই,
এক বেদনার ‘কমরেড’ভাই মোরা সবাই।
সকল দেশের মোরা সকল ।
রে চির-যাত্রী পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
বলগা্-বিহীন শৃঙ্খল-ছেঁড়া প্রিয় তরুণ!
তোদের দেখিয়া টগবগ করে বক্ষে খুন।
কাঁদি বেদনায়, তবু রে তোদের ভালোবাসায়
উল্লাসে নাচি আপনা-বিভোল,নব আশায়।
ভাগ্য-দেবীর লীলা-কমল,
অগ্রপথিক রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
তরুণ তাপস! নব শক্তিরে জাগায়ে তোল।
করুণার নয়–ভয়ংকরীর দুয়ার খোল।
নাগিনি-দশনা রণরঙ্গিণী শস্ত্রকর
তোর দেশ-মাতা, তাহারই পতাকা তুলিয়া ধর।
রক্ত-পিয়াসি অচঞ্চল
নির্মম-ব্রত রে সেনাদল!
জোর কদম চল রে চল॥
অভয়-চিত্ত ভাবনা-মুক্ত যুবারা, শুন!
মোদের পিছনে চিৎকার করে পশু, শকুন।
ভ্রুকুটি হানিছে পুরাতন পচা গলিতে শব,
রক্ষণশীল বুড়োরা করছি তারই স্তব
শিবারা চেঁচাক, শিব অটল!
নির্ভীক বীর পথিক-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আগে – আরও আগে সেনা-মুখ যথা করিছে রণ,
পলকে হতেছে পূর্ণ মৃতের শূন্যাসন,
আছে ঠাঁই আছে, কে থামে পিছনে? হ আগুয়ান!
যুদ্ধের মাঝে পরাজয় মাঝ চলো জোয়ান!
জ্বাল রে মশাল জ্বাল অনল!
অগ্রযাত্রী রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
নতুন করিয়া ক্লান্ত ধরার মৃত শিরায়
স্পন্দন জাগে আমাদের তরে, নব আশায়।
আমাদেরই তারা – চলিছে যাহারা দৃঢ় চরণ
সম্মুখ পানে, একাকী অথবা শতেক জন।
মোরা সহস্র-বাহু-সবল।
রে চির-রাতের সন্ত্রিদল,
জোর কদম চল রে চল॥
জগতের এই বিচিত্রতম মিছিলে ভাই
কত রূপ কত দৃশ্যের লীলা চলে সদাই!–
শ্রমরত ওই কালি-মাখা কুলি, নৌ-সারং,
বলদের মাঝে হলধর চাষা দুখের সং,
প্রভু স-ভৃত্য পেষণ-কল, –
অগ্র-পথিক উদাসী-দল,
জোর কদম চল রে চল॥
নিখিল গোপন ব্যর্থ-প্রেমিক আর্ত-প্রাণ
সকল কারার সকল বন্দী আহত-মান,
ধরার সকল সুখী ও দুঃখী, সৎ, অসৎ,
মৃত, জীবন্ত, পথ-হারা, যারা ভোলেনি পথ, –
আমাদের সাথি এরা সকল।
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোরকদম চল রে চল॥
ছুঁড়িতেছে ভাঁটা জ্যোতির্চক্র ঘূর্ণমান
হেরো পুঞ্জিত গ্রহ-রবি-তারা দীপ্তপ্রাণ;
আলো-ঝলমল দিবস, নিশীথ স্বপ্নাতুর, –
বন্ধুর মতো চেয়ে আছে সবে নিকট-দূর।
এক ধ্রুব সবে পথ-উতল।
নব যাত্রিক পথিক দল,
জোর কদম চল রে চল॥
আমাদের এরা, আছে এরা সবে মোদের সাথ,
এরা সখা – সহযাত্রী মোদের দিবস-রাত।
ভ্রূণ-পথে আসে মোদের পথের ভাবী পথিক,
এ মিছিলে মোরা অগ্র-যাত্রী সুনির্ভিক।
সুগম করিয়া পথ পিছল
অগ্র-পথিক রে সেনাদল,
জোর কদম চল রে চল॥
ওগো ও প্রাচী-র দুলালি দুহিতা তরুণীরা,
ওগো জায়া ওগো ভগিনীরা। ডাকে সঙ্গীরা।
উঠুক তোমার মণি-মঞ্জীর ঘন বাজি
আমাদের পথে চল-চপল।
অগ্র-পথিক তরুণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
ওগো অনাগত মরু-প্রান্তর বৈতালিক!
শুনিতেছি তব আগমনি-গীতি দিগ্বিদিক।
আমাদেরই মাঝে আসিতেছ তুমি দ্রুত পায়ে। –
ভিন-দেশী কবি! থামাও বাঁশরি বট-ছায়ে,
তোমার সাধনা আজি সফল।
অগ্র-পথিক চারণ-দল
জোর কদম চল রে চল॥
আমরা চাহি না তরল স্বপন, হালকা সুখ,
আরাম-কুশন, মখমল-চটি, পানসে থুক
শান্তির বাণী, জ্ঞান-বানিয়ার বই-গুদাম,
ছেঁদো ছন্দের পলকা, উর্ণা, সস্তা নাম,
পচা দৌলত; – দুপায়ে দল!
কঠোর দুখের তাপসদল,
জোর কদম চল রে চল॥
পান-আহার ভোজে মত্ত কি যত ঔদরিক?
দুয়ার জানালা বন্ধ করিয়া ফেলিয়া চিক
আরাম করিয়া ভুঁড়োরা ঘুমায়?–বন্ধু, শোন,
মোটা ডালরুটি, ছেঁড়া কম্বল,ভূমি-শয়ন,
আছে তো মোদের পাথেয়-বল!
ওরে বেদনার পূজারি দল,
মোছ রে অশ্রু, চল রে চল॥
নেমেছে কি রাতি? ফুরায় না পথ সুদুর্গম?
কে থামিস পথে ভগ্নোৎসাহ নিরুদ্যম?
বসে নে খানিক পথ-মঞ্জিলে, ভয় কী ভাই,
থামিলে দুদিন ভোলে যদি লোকে – ভুলুক তাই!
মোদের লক্ষ্য চির-অটল!
অগ্র-পথিক ব্রতীর দল,
বাঁদরে বুক, চল রে চল॥
শুনিতেছি আমি, শোন ওই দূরে তূর্য-নাদ
ঘোষিছে নবীন উষার উদয়-সুসংবাদ!
ওরে ত্বরা কর! ছুটে চল আগে – আরও আগে!
গান গেয়ে চলে অগ্র-বাহিনী, ছুটে চল তারও পুরোভাগে!
তোর অধিকার কর দখল!
অগ্র-নায়ক রে পাঁওদল!
জোর কদম চল রে চল॥
(জিঞ্জির কাব্যগ্রন্থ)
আশা (পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
Friday, May 18, 2018, 1:44 AM
মহান তুমি প্রিয়
এই কথাটির গৌরবে মোর চিত্ত ভরে দিয়ো।
অনেক আশায় বসে আছি যাত্রা-শেষের পর
তোমায় নিয়েই পথের পারে বাঁধব আমার ঘর –
হে চির-সুন্দর!
পথ শেষ সেই তোমায় যেন করতে পারি ক্ষমা,
হে মোর কলঙ্কিনী প্রিয়তমা!
সেদিন যেন বলতে পারি, ‘এসো এসো প্রিয়,
বক্ষে এসো এসো আমার পূত কমনীয়!’
হায় হারানো লক্ষ্মী আমার! পথ ভুলেছ বলে
চির-সাথি যাবে তোমার মুখ ফিরিয়ে চলে?
জান ওঠে হায় মোচড় খেয়ে চলতে পড়ি টলে –
অনেক জ্বালায় জ্বলে প্রিয় অনেক ব্যথায় গলে!
বারে বারে নানান রূপে ছলতে আমায় শেষে,
কলঙ্কিনী! হাতছানি দাও সকল পথে এসে
কুটিল হাসি হেসে?
ব্যথায় আরো ব্যথা হানাই যে সে!
তুমি কি চাও তোমার মতোই কলঙ্কী হই আমি?
তখন তুমি সুদূর হতে আসবে ঘরে নামি –
হে মোর প্রিয়, হে মোর বিপথগামী!
পথের আজও অনেক বাকি,
তাই যদি হয় প্রিয় –
পথের শেষে তোমায় পাওয়ার যোগ্য করেই নিয়ো॥
(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
অবসর
Thursday, May 17, 2018, 5:26 PM
লক্ষ্মী আমার! তোমার পথে আজকে অভিসার,
অনেক দিনের পর পেয়েছি মুক্তি-রবিবার।
দিনের পর দিন গিয়েছে হয়নি আমার ছুটি,
বুকের ভিতর ব্যর্থ কাঁদন পড়ত বৃথাই লুটি
বসে ঢুলত আঁখি দুটি!
আহা আজ পেয়েছি মুক্ত হাওয়া
লাগল চোখে তোমার চাওয়া
তাইতো প্রাণে বাঁধ টুটেছে রুদ্ধ কবিতার।
তোমার তরে বুকের তলায় অনেক দিনের অনেক কথা জমা,
কানের কাছে মুখটি থুয়ে গোপন সে-সব কইব প্রিয়তমা!
এবার শুধু কথায় গানে রাত্রি হবে ভোর
শুকতারাতে কাঁপবে তোমার নয়ন-পাতার লোর
অভি-মানিনীরে মোর!
যখন তোমায় সেধে ডাকবে বাঁশি
মলিন মুখে ফুটবে হাসি,
হিম-মুকুরে উঠবে ভাসি
অরুণ ছবি তার।
(পুবের হাওয়া কাব্যগ্রন্থ)
হারামণি
Thursday, May 17, 2018, 5:33 PM
এমন করে অঙ্গনে মোর ডাক দিলি কে স্নেহের কাঙালি!
কে রে ও তুই কে রে?
আহা ব্যথার সুরে রে,
এমন চেনা স্বরে রে,
আমার ভাঙা ঘরের শূন্যতারই বুকের পরে রে।
এ কোন পাগল স্নেহ-সুরধুনীর আগল ভাঙালি?
কোন্ জননির দুলাল রে তুই, কোন্ অভাগির হারামণি,
চোখ-ভরা তোর কাজল চোখে রে
আহা ছলছল কাঁদন চাওয়ার সজল ছায়া কালো মায়া
সারাখনই উছলে যেন পিছল ননি রে!
মুখভরা তোর ঝরনাহাসি
শিউলি সম রাশি রাশি
আমার মলিন ঘরের বুকে মুখে লুটায় আসি রে!
বুক-জোড়া তোর ক্ষুদ্ধ স্নেহ দ্বারে দ্বারে কর হেনে যে যায়
কেউ কি তারে ডাক দিল না? ডাকল যারা তাদের কেন
দলে এলি পায়?
কেন আমার ঘরের দ্বারে এসেই আমার পানে চেয়ে এমন
থমকে দাঁড়ালি?
এমন চমকে আমায় চমক লাগালি?
এই কি রে তোর চেনা গৃহ, এই কিরে তোর চাওয়া স্নেহ হায়!
তাই কি আমার দুখের কুটির হাসির গানের রঙে রাঙালি?
হে মোর স্নেহের কাঙালি।
এ সুর যেন বড়োই চেনা, এ স্বর যেন আমার বাছার,
কখন সে যে ঘুমের ঘোরে হারিয়েছিনু হয় না মনে রে!
না চিনেই আজ তোকে চিনি, আমারই সেই বুকের মানিক,
পথ ভুলে তুই পালিয়ে ছিলি সে কোন ক্ষণে সে কোন বনে রে!
দুষ্টু ওরে, চপল ওরে, অভিমানী শিশু!
মনে কি তোর পড়ে না তার কিছু?
সেই অবধি জাদুমণি কত শত জনম ধরে
দেশ বিদেশে ঘুরে ঘুরে রে,
আমি মা-হারা সে কতই ছেলের কতই মেয়ের
মা হয়ে বাপ খুঁজেছি তোরে!
দেখা দিলি আজকে ভোরে রে!
উঠছে বুকে হাহা ধ্বনি
আয় বুকে মোর হারামণি,
আমি কত জনম দেখিনি যে ওই মু-খানি রে!
পেটে-ধরা নাই বা হলি, চোখে ধরার মায়াও নহে এ,
তোকে পেতেই জন্ম জন্ম এমন করে বিশ্ব-মায়ের
ফাঁদ পেতেছি যে!
আচমকা আজ ধরা দিয়ে মরা-মায়ের ভরা-স্নেহে হঠাৎ জাগালি।
গৃহহারা বাছা আমার রে!
চিনলি কি তুই হারা-মায়ে চিনলি কি তুই আজ?
আজকে আমার অঙ্গনে তোর পরাজয়ের বিজয়-নিশান
তাই কি টাঙালি?
মোর স্নেহের কাঙালি।
(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
হার-মানা-হার
Friday, May 18, 2018, 3:14 AM
তোরা কোথা হতে কেমনে এসে
মণি-মালার মতো আমার কণ্ঠে জড়ালি।
আমার পথিক-জীবন এমন করে
ঘরের মায়ায় মুগ্ধ করে বাঁধন পরালি।
আমায় বাঁধতে যারা এসেছিল গরব করে হেসে
তারা হার মেনে হায় বিদায় নিল কেঁদে,
তোরা কেমন করে ছোট্ট বুকের একটু ভালোবেসে
ওই কচি বাহুর রেশমি ডোরে ফেললি আমায় বেঁধে!
তোরা চলতে গেলে পায়ে জড়াস,
‘না’ ‘না’ বলে ঘাড়টি নড়াস,
কেন ঘর-ছাড়াকে এমন করে
ঘরের ক্ষুধা স্নেহের সুধা মনে পড়ালি।
ওরে চোখে তোদের জল আসে না–
চমকে ওঠে আকাশ তোদের
চোখের মুখের চপল হাসিতে।
ওই হাসিই তো মোর ফাঁসি হল,
ওকে ছিঁড়তে গেলে বুকে লাগে,
কাতর কাঁদন ছাপা যে ও হাসির রাশিতে!
আমি চাইলে বিদায় বলিস, ‘উঁহু,
ছাড়ব নাকো মোরা’
ওই একটু মুখের ছোট্ট মানাই এড়িয়ে যেতে নারি,
কত দেশ-বিদেশের কান্নাহাসির
বাঁধনছেঁড়ার দাগ যে বুকে পোরা,
তোরা বসলি রে সেই বুক জুড়ে আজ,
চিরজয়ীর রথটি নিলি কাড়ি।
ওরে দরদিরা! তোদের দরদ
শীতের বুকে আনলে শরৎ,
তোরা ঈষৎ-ছোঁয়ায় পাথরকে আজ
কাতর করে অশ্রুভরা ব্যথায় ভরালি।
(ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)
Comments
Post a Comment