বাংলা কবিতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর কবিতা

নৈবেদ্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-

তোমারে দিই নি সুখ, মুক্তির নৈবেদ্য গেনু রাখি

রজনীর শুভ্র অবসানে ; কিছু আর নাহি বাকি,

নাইকো প্রার্থনা, নাই প্রতি মুহূর্তের দৈন্যরাশি,

নাই অভিমান, নাই দীনকান্না, নাই গর্বহাসি,

নাই পিছে ফিরে দেখা। শুধু সে মুক্তির ডালিখানি

ভরিয়া দিলাম আজি আমার মহৎ মৃত্যু আনি।
 ------------------------------------------------------

দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে


দয়া দিয়ে হবে গো মোর
জীবন ধুতে–
নইলে কি আর পারব তোমার
চরণ ছুঁতে।
তোমায় দিতে পূজার ডালি
বেড়িয়ে পড়ে সকল কালি,
পরান আমার পারি নে তাই
পায়ে থুতে।

এতদিন তো ছিল না মোর
কোনো ব্যথা,
সর্ব অঙ্গে মাখা ছিল
মলিনতা।
আজ ওই শুভ্র কোলের তরে
ব্যাকুল হৃদয় কেঁদে মরে
দিয়ো না গো, দিয়ো না আর
ধুলায় শুতে।

-----------------------------------------------------------

দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে


দয়া করে ইচ্ছা করে আপনি ছোটো হয়ে
এসো তুমি এ ক্ষুদ্র আলয়ে।
তাই তোমার মাধুর্যসুধা
ঘুচায় আমার আঁখির ক্ষুধা,
জলে স্থলে দাও যে ধরা
কত আকার লয়ে।

বন্ধু হয়ে পিতা হয়ে জননী হয়ে
আপনি তুমি ছোটো হয়ে এসো হৃদয়ে।
আমিও কি আপন হাতে
করব ছোটো বিশ্বনাথে।
জানাব আর জানব তোমায়
ক্ষুদ্র পরিচয়ে?

-------------------------------------------------------

দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে
Thursday, May 17, 2018, 9:14 PM

দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,
আপন জেনে আদর করি নে।
পিতা বলে প্রণাম করি পায়ে,
বন্ধু বলে দু-হাত ধরি নে।
আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে
আমার হয়ে এলে যেথায় নেমে
সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধরে
সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে।

ভাই তুমি যে ভায়ের মাঝে প্রভু,
তাদের পানে তাকাই না যে তবু,
ভাইয়ের সাথে ভাগ ক’রে মোর ধন
তোমার মুঠা কেন ভরি নে।
ছুটে এসে সবার সুখে দুখে
দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে,
সঁপিয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে
প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে।

---------------------------------------------

দুঃস্বপন কোথা হতে এসে
Friday, May 18, 2018, 9:55 AM

দুঃস্বপন কোথা হতে এসে
জীবনে বাধায় গণ্ডগোল।
কেঁদে উঠে জেগে দেখি শেষে
কিছু নাই আছে মার কোল।
ভেবেছিনু আর-কেহ বুঝি,
ভয়ে তাই প্রাণপণে যুঝি,
তব হাসি দেখে আজ বুঝি
তুমিই দিয়েছ মোরে দোল।

এ জীবন সদা দেয় নাড়া
লয়ে তার সুখ দুখ ভয়;
কিছু যেন নাই গো সে ছাড়া,
সেই যেন মোর সমুদয়।
এ ঘোর কাটিয়া যাবে চোখে
নিমেষেই প্রভাত-আলোকে,
পরিপূর্ণ তোমার সম্মুখে
থেমে যাবে সকল কল্লোল।

৮ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
------------------------------------

দিবস যদি সাঙ্গ হল না যদি গাহে পাখি
Friday, May 18, 2018, 11:17 AM

দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি,
ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে–
এবার তবে গভীর করে ফেলো গো মোরে ঢাকি
অতি নিবিড় ঘন তিমিরতলে
স্বপন দিয়ে গোপনে ধীরে ধীরে
যেমন করে ঢেকেছ ধরণীরে,
যেমন করে ঢেকেছ তুমি মুদিয়া-পড়া আঁখি,
ঢেকেছ তুমি রাতের শতদলে।

পাথেয় যার ফুরায়ে আসে পথের মাঝখানে,
ক্ষতির রেখা উঠেছে যার ফুটে,
বসনভূষা মলিন হল ধুলায় অপমানে
শকতি যার পড়িতে চায় টুটে–
ঢাকিয়া দিক তাহার ক্ষতব্যথা
করুণাঘন গভীর গোপনতা,
ঘুচায়ে লাজ ফুটাও তারে নবীন উষাপানে
জুড়ায়ে তারে আঁধার সুধাজলে।

কলিকাতা, ২৯ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)

--------------------------------------

দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও
Thursday, May 17, 2018, 10:53 PM

দাও হে আমার ভয় ভেঙে দাও।
আমার দিকে ও মুখ ফিরাও।
পাশে থেকে চিনতে নারি,
কোন্‌ দিকে যে কী নেহারি,
তুমি আমার হৃদ্‌বিহারী
হৃদয়পানে হাসিয়া চাও।

বলো আমায় বলো কথা,
গায়ে আমার পরশ করো।
দক্ষিণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে
আমায় তুমি তুলে ধরো।
যা বুঝি সব ভুল বুঝি হে,
যা খুঁজি সব ভুল খুঁজি হে–
হাসি মিছে,কান্না মিছে,
সামনে এসে এ ভুল ঘুচাও।

১৬ ভাদ্র, ১৩১৬
----------------------------------------------

তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি
Friday, May 18, 2018, 9:58 AM

তোরা শুনিস নি কি শুনিস নি তার পায়ের ধ্বনি,
ওই যে আসে, আসে, আসে।
যুগে যুগে পলে পলে দিনরজনী
সে যে আসে, আসে, আসে।
গেয়েছি গান যখন যত
আপন-মনে খ্যাপার মতো
সকল সুরে বেজেছে তার
আগমনী-
সে যে আসে, আসে, আসে।

কত কালের ফাগুন-দিনে বনের পথে
সে যে আসে, আসে, আসে।
কত শ্রাবণ অন্ধকারে মেঘের রথে
সে যে আসে, আসে, আসে।

দুখের পরে পরম দুখে,
তারি চরণ বাজে বুকে,
সুখে কখন্‌ বুলিয়ে সে দেয়
পরশমণি।
সে যে আসে, আসে, আসে।

কলিকাতা, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
-------------------------------------------

তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর
Friday, May 18, 2018, 8:20 AM

তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর,
যবে আমার জনম হবে ভোর।
চলে যাব নবজীবন-লোকে,
নূতন দেখা জাগবে আমার চোখে,
নবীন হয়ে নূতন সে আলোকে
পরব তব নবমিলন-ডোর।
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।

তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই,
বারে বারে নূতন লীলা তাই।
আবার তুমি জানি নে কোন্‌ বেশে
পথের মাঝে দাঁড়াবে, নাথ, হেসে,
আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে,
লাগবে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর।
তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর।

১০ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
--------------------------
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
Friday, May 18, 2018, 8:03 AM

তোমায় আমার প্রভু করে রাখি
আমার আমি সেইটুকু থাক্‌ বাকি।
তোমায় আমি হেরি সকল দিশি,
সকল দিয়ে তোমার মাঝে মিশি,
তোমারে প্রেম জোগাই দিবানিশি,
ইচ্ছা আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি–
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।

তোমায় আমি কোথাও নাহি ঢাকি
কেবল আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি।
তোমার লীলা হবে এ প্রাণ ভরে
এ সংসারে রেখেছ তাই ধরে,
রইব বাঁধা তোমার বাহুডোরে
বাঁধন আমার সেইটুকু থাক্‌ বাকি–
তোমায় আমার প্রভু করে রাখি।

১৫ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
তোমার সাথে নিত্য বিরোধ আর সহে না
Thursday, May 17, 2018, 8:14 PM

তোমার সাথে নিত্য বিরোধ
আর সহে না–
দিনে দিনে উঠছে জমে
কতই দেনা।
সবাই তোমায় সভার বেশে
প্রণাম করে গেল এসে,
মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই
মান রহে না।

কী জানাব চিত্তবেদন,
বোবা হয়ে গেছে যে মন,
তোমার কাছে কোনো কথাই
আর কহে না।
ফিরায়ো না এবার তারে
লও গো অপমানের পারে,
করো তোমার চরণতলে
চির-কেনা।

বোলপুর, ২৫ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
---------------------------------

তোমার প্রেম যে বইতে পারি এমন সাধ্য নাই
Thursday, May 17, 2018, 6:21 PM

তোমার প্রেম যে বইতে পারি
এমন সাধ্য নাই।
এ সংসারে তোমার আমার
মাঝখানেতে তাই
কৃপা করে রেখেছ  নাথ
অনেক ব্যবধান–
দুঃখসুখের অনেক বেড়া
ধনজনমান।

আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে
আভাসে দাও দেখা–
কালো মেঘের ফাঁকে ফাঁকে
রবির মৃদু রেখা।
শক্তি যারে দাও বহিতে
অসীম প্রেমের ভার
একেবারে সকল পর্দা
ঘুচায়ে দাও তার।

না রাখ তার ঘরের আড়াল
না রাখ তার ধন,
পথে এনে নিঃশেষে তায়
কর অকিঞ্চন।
না থাকে তার মান অপমান,
লজ্জা শরম ভয়,
একলা তুমি সমস্ত তার
বিশ্বভুবনময়।

এমন করে মুখোমুখি
সামনে তোমার থাকা,
কেবলমাত্র তোমাতে প্রাণ
পূর্ণ করে রাখা,
এ দয়া যে পেয়েছে তার
লোভের সীমা নাই–
সকল লোভে সে সরিয়ে ফেলে
তোমায় দিতে ঠাঁই।

তিনধরিয়া, ১০ জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
------------------------------------

তোমার দয়া যদি চাহিতে নাও জানি
Thursday, May 17, 2018, 6:21 PM

তোমার দয়া যদি
চাহিতে নাও জানি
তবুও দয়া করে
চরণে নিয়ো টানি।
আমি যা গড়ে তুলে
আরামে থাকি ভুলে
সুখের উপাসনা
করি গো ফলে ফুলে–
সে ধুলা-খেলাঘরে
রেখো না ঘৃণাভরে,
জাগায়ো দয়া করে
বহ্নি-শেল হানি।

সত্য মুদে আছে
দ্বিধার মাঝখানে,
তাহারে তুমি ছাড়া
ফুটাতে কে বা জানে।
মৃত্যু ভেদ করি’
অমৃত পড়ে ঝরি’,
অতল দীনতার
শূন্য উঠে ভরি’
পতন-ব্যথা মাঝে
চেতনা আসি বাজে,
বিরোধ কোলাহলে
গভীর তব বাণী।

২২ শ্রাবণ, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)

-------------------------------


তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ
Thursday, May 17, 2018, 6:21 PM

তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ
দুখের অশ্রুধার।
জননী গো, গাঁথব তোমার
গলার মুক্তাহার।
চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে
মালা হয়ে জড়িয়ে আছে,
তোমার বুকে শোভা পাবে আমার
দুখের অলংকার।

ধন ধান্য তোমারি ধন,
দিতে চাও তো দিয়ো আমায়,
নিতে চাও তো লও।
দুঃখ আমার ঘরের জিনিস,
খাঁটি রতন তুই তো চিনিস–
তোর প্রসাদ দিয়ে তারে কিনিস,
এ মোর অহংকার।

১৩১৫
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
-----------------------------------
তুমি এবার আমায় লহো
Thursday, May 17, 2018, 6:20 PM

তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ, লহো।
এবার তুমি ফিরো না হে–
হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো।
যে দিন গেছে তোমা বিনা
তারে আর ফিরে চাহি না,
যাক সে ধুলাতে।
এখন  তোমার আলোয় জীবন মেলে
যেন  জাগি অহরহ।

কী আবেশে কিসের কথায়
ফিরেছি হে যথায় তথায়
পথে প্রান্তরে,
এবার  বুকের কাছে ও মুখ রেখে
তোমার আপন বাণী কহো।

কত কলুষ কত ফাঁকি
এখনো যে আছে বাকি
মনের গোপনে,
আমায় তার লাগি আর ফিরায়ো না,
তারে
আগুন দিয়ে দহো।

২৮ চৈত্র, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
-----------------------------------

তুমি যে কাজ করছ আমায়
Thursday, May 17, 2018, 6:36 PM

তুমি যে কাজ করছ, আমায়
সেই কাজে কি লাগাবে না।
কাজের দিনে আমায় তুমি
আপন হাতে জাগাবে না?
ভালোমন্দ ওঠাপড়ায়
বিশ্বশালার ভাঙাগড়ায়
তোমার পাশে দাঁড়িয়ে যেন
তোমার সাথে হয় গো চেনা।

ভেবেছিলেম বিজন ছায়ায়
নাই যেখানে আনাগোনা,
সন্ধ্যাবেলায় তোমায় আমায়
সেথায় হবে জানাশোনা।
অন্ধকারে একা একা
সে দেখা যে স্বপ্ন দেখা,
ডাকো তোমার হাটের মাঝে
চলছে যেথায় বেচাকেনা।

৬ আষাঢ়, ১৩১৭
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
-----------------------
তুমি আমার আপন
Thursday, May 17, 2018, 6:35 PM

তুমি আমার আপন, তুমি আছ আমার কাছে,
এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।
তোমার মাঝে মোর জীবনের সব আনন্দ আছে,
এই কথাটি বলতে দাও হে বলতে দাও।

আমায়             দাও সুধাময় সুর,
আমার             বাণী করো সুমধুর;
আমার             প্রিয়তম তুমি, এই কথাটি
বলতে দাও হে বলতে দাও।

এই          নিখিল আকাশ ধরা
এই যে      তোমায় দিয়ে ভরা,
আমার      হৃদয় হতে এই কথাটি
বলতে দাও হে বলতে দাও।

দুখি      জেনেই কাছে আস,
ছোটো   বলেই ভালোবাস,
আমার   ছোটো মুখে এই কথাটি
বলতে দাও হে বলতে দাও।

মাঘ, ১৩১৬
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে
Thursday, May 17, 2018, 6:09 PM

তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।
এসো গন্ধে বরনে, এসো গানে।
এসো অঙ্গে পুলকময় পরশে,
এসো চিত্তে অমৃতময় হরষে,
এসো মুগ্ধ মুদিত দু নয়ানে।
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।

এসো নির্মল উজ্জ্বল কান্ত,
এসো সুন্দর স্নিগ্ধ প্রশান্ত,
এসো এসো হে বিচিত্র বিধানে।
এসো দুঃখে সুখে, এসো মর্মে,
এসো নিত্য নিত্য সব কর্মে;
এসো সকল-কর্ম-অবসানে।
তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।

অগ্রহায়ণ, ১৩১৪?
(গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ)

Comments

Popular posts from this blog

সৈয়দ শামসুল হক-এর কবিতা

সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর কবিতা