জীবনানন্দ দাশ

জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা

তবু
Friday, May 18, 2018, 5:13 AM

সে অনেক রাজনীতি রুগ্ন নীতি মারী
মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে
উঠে এসে এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার
বছরে বয়সী আমি;
বুদ্ধকে স্বচক্ষে মহানির্বাণের আশ্চর্য শান্তিতে
চ’লে যেতে দেখে— তবু—অবিরল অশান্তির দীপ্তি ভিক্ষা ক’রে
এখানে তোমার কাছে দাঁড়ায়ে রয়েছি;
আজ ভোরে বাংলার তেরোশো চুয়ান্ন সাল এই
কোথাও নদীর জলে নিজেকে গণনা ক’রে নিতে ভুলে গিয়ে
আগামী লোকের দিকে অগ্রসর হ’য়ে যায়; আমি
তবুও নিজেকে রোধ ক’রে আজ থেমে যেতে চাই
তোমার জ্যোতির কাছে; আড়াই হাজার
বছর তা হ’লে আজ এইখানে শেষ হ’য়ে গেছে।

নদীর জলের পথে মাছরাঙা ডান বাড়াতেই
আলো ঠিকরায়ে গেছে— যারা পথে চ’লে যায় তাদের হৃদয়ে;
সৃষ্টির প্রথম আলোর কাছে; আহা,
অন্তিম আভার কাছে; জীবনের যতিহীন প্রগতিশীলতা
নিখিলের স্মরণীয় সত্য ব’লে প্রমাণিত হ’য়ে গেছে; দ্যাখো
পাখি চলে, তারা চলে, সূর্য মেঘে জ্ব’লে যায়, আমি
তবুও মধ্যম পথে দাঁড়ায়ে রয়েছি— তুমি দাঁড়াতে বলোনি।


আমাকে দ্যাখোনি তুমি; দেখাবার মতো
অপব্যয়ী কল্পনার ইন্দ্রত্বের আসনে আমাকে
বসালে চকিত হ’য়ে দেখে যেতে যদি— তবু, সে-আসনে আমি
যুগে-যুগে সাময়িক শত্রুদের বসিয়েছি, নারি,
ভালোবেসে ধ্বংস হ’য়ে গেছে তা’রা সব।
এ-রকম অন্তহীন পটভূমিকায়— প্রেমে—
নতুন ঈশ্বরদের বার-বার লুপ্ত হ’তে দেখে
আমারো হৃদয় থেকে তরুণতা হারায়ে গিয়েছে;
অথচ নবীন তুমি।

নারি, তুমি সকালের জল উজ্জ্বলতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো নদীকেই
বিকেলে অপর ঢেউয়ে খরশান হ’তে
দিতে ভুলে গিয়েছিলে; রাতের প্রখর জলে নিয়তির দিকে
ব’হে যেতে দিতে মনে ছিলো কি তোমার?
এখনও কি মনে নেই?

আজ এই পৃথিবীর অন্ধকারে মানুষের হৃদয়ে বিশ্বাস
কেবলি শিথিল হ’য়ে যায়; তবু তুমি
সেই শিথিলতা নও, জানি, তবু ইতিহাসরীতিপ্রতিভার
মুখোমুখি আবছায়া দেয়ালের মতো নীল আকাশের দিকে
ঊর্ধ্বে উঠে যেতে চেয়ে তুমি
আমাদের দেশে কোনো বিশ্বাসের দীর্ঘ তরু নও।

তবু
কী যে উদয়ের সাগরের প্রতিবিম্ব জ্ব’লে ওঠে রোদে!
উদয় সমাপ্ত হ’য়ে গেছে নাকি সে অনেক আগে?
কোথাও বাতাস নেই, তবু
মৰ্মরিত হ’য়ে ওঠে উদয়ের সমুদ্রের পারে।


কোনো পাখি
কালের ফোকরে আজ নেই, তবু, নব সৃষ্টিমরালের মতো কলস্বরে
কেন কথা বলি; কোনো নারী
নেই, তবু আকাশহংসীর কণ্ঠে ভোরের সাগর উতরোল।

    (সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থ)
--------------------------------------

মনোকণিকা
Friday, May 18, 2018, 5:50 AM

ও. কে.

একটি বিপ্লবী তার সোনা রুপো ভালোবেসেছিলো;
একটি বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে;
একটি প্রেমিক তার মহিলাকে ভালোবেসেছিলো;
তবুও মহিলা প্রীত হয়েছিলো দশজন মূর্থের বিক্ষোভে।

বুকের উপরে হাত রেখে দিয়ে তা’রা
নিজেদের কাজ ক’রে গিয়েছিলো সব।

অবশেষে তা’রা আজ মাটির ভিতরে
অপরের নিয়মে নীরব।

মাটির আহ্নিক গতি সে-নিয়ম নয়;
সূর্য তার স্বাভাবিক চোখে
সে-নিয়ম নয়— কেউ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়;
সব দিক ও. কে.।
---------------------------
সাবলীল

আকাশে সূৰ্যের আলো থাকুক না— তবু—
দণ্ডাজ্ঞার ছায়া আছে চিরদিন মাথার উপরে।
আমরা দণ্ডিত হ’য়ে জীবনের শোভা দেখে যাই।
মহাপুরুষের উক্তি চারিদিকে কোলাহল করে।

মাঝে-মাঝে পুরুষাৰ্থ উত্তেজিত হ’লে—
(এ রকম উত্তেজিত হয়;)
উপস্থাপয়িতার মতন
অামাদের চায়ের সময়

এসে প’ড়ে আমাদের স্থির হ’তে বলে।
সকলেই স্নিগ্ধ হ’য়ে আত্মকর্মক্ষম;
এক পৃথিবীর দ্বেষ হিংসা কেটে ফেলে
চেয়ে দ্যাখে স্তূপাকারে কেটেছে রেশম।

এক পৃথিবীর মতো বর্ণময় রেশমের স্তূপ কেটে ফেলে
পুনরায় চেয়ে দ্যাখে এসে গেছে অপরাহ্ণকাল:
প্রতিটি রেশম থেকে সীতা তার অগ্নিপরীক্ষায়—
অথবা খ্রীষ্টের রক্ত করবী ফুলের মতো লাল।

মানুষ সর্বদা যদি

মানুষ সর্বদা যদি নরকের পথ বেছে নিতো—
(স্বর্গে পৌঁছুবার লোভ সিদ্ধার্থও গিয়েছিলো ভুলে),
অথবা বিষম মদ স্বতই গেলাসে ঢেলে নিতো,
পরচুলা এঁটে নিতো স্বাভাবিক চুলে,
সর্বদা এ-সব কাজ ক’রে যেত যদি
যেমন সে প্রায়শই করে,
পরচুলা তবে কার সন্দেহের বস্তু হ’তো, আহা,
অথবা মুখোশ খুলে খুশি হ’তো কে নিজের মুখের রগড়ে।

চার্বাক প্রভৃতি—

‘কেউ দূরে নেপথ্যের থেকে, মনে হয়,
মানুষের বৈশিষ্ট্যের উত্থান-পতন
একটি পাখির জন্ম— কীচকের জন্মমৃত্যু সব
বিচারসাপেক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে।

‘তবু এই অনুভূতি আমাদের মর্ত্য জীবনের
কিংবা মরণের কোনো মূলসূত্র নয়।
তবুও শৃঙ্খলা ভালোবাসি ব’লে হেঁয়ালি ঘনালে
মৃত্তিকার অন্ধ সত্যে অবিশ্বাস হয়।’

ব’লে গেল বায়ুলোকে নাগার্জুন, কৌটিল্য, কপিল,
চার্বাক প্রভৃতি নিরীশ্বর;
অথবা তা এডিথ, মলিনা নাম্নী অগণন নার্সের ভাষা—
অবিরাম যুদ্ধ আর বাণিজ্যের বায়ুর ভিতর।
------------------------------------------------------
সমুদ্রতীরে

পৃথিবীতে তামাশার সুর ক্রমে পরিচ্ছন্ন হ’য়ে
জন্ম নেবে একদিন। আমোদ গভীর হ’লে সব
বিভিন্ন মানুষ মিলে মিশে গিয়ে যে-কোনো আকাশে
মনে হবে পরস্পরের প্রিয়প্রতিষ্ঠ মানব।

এই সব বোধ হয় আজ এই ভোরের অালোর পথে এসে
জুহুর সমুদ্রপারে, অগণন ঘোড়া ও ঘেসেড়াদের ভিড়ে।
এদের স্বজন, বোন, বাপ-মা ও ভাই, ট্যাঁক, ধর্ম মরেছে;
তবুও উচ্চস্বরে হেসে ওঠে অফুরন্ত রৌদ্রের তিমিরে।

   (মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ)
অনুপম ত্রিবেদী
Friday, May 18, 2018, 8:08 AM

এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে।
যদিও সে নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে
সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা
এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা
হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তুপ দেখে মনে হয়
যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফ্রয়েড নিজ নিজ চিন্তার বিষয়
পরিশেষ করে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে
এখন ঘুমায়ে আছে—তাহাদের ঘুম ভেঙে দিতে
নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে—ওই পারে মৃত্যুর তালা
ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিস্টিক ইহুদী কাবালা
ঈশার শবোত্থান—বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু ক’রে
হেগেল ও মার্কস : তার ডান আর বাম কান ধ’রে
দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিল; এমন সময়
দু পকেটে হাত রেখে ভ্রুকুটির চোখে নিরাময়
জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম;
প্রেমের চেয়েও ভালো মনে হল একটি টোটেম :
উটের ছবির মতো—একজন নারীর হৃদয়ে;
মুখে-চোখে আকুতিতে মরীচিকা জয়ে
চলেছে সে; জড়ায়েছে ঘিয়ের রঙের মতো শাড়ি;
ভালো ক’রে দেখে নিলে মনে হয় অতীব চতুর দক্ষিণরাঢ়ী
দিব্য মহিলা এক; কোথায় সে আঁচলের খুঁট;
কেবলই উত্তরপাড়া ব্যাণ্ডেল কাশীপুর বেহালা খুরুট
ঘুরে যায় স্টালিন, নেহেরু, ব্লক, অথবা রায়ের বোঝা ব’য়ে,
ত্রিপাদ ভূমির পরে আরো ভূমি আছে এই বলির হৃদয়ে?
তা হলে তা প্রেম নয়; ভেবে গেল ত্রিবেদীর হৃদয়ের জ্ঞান।
জড় ও অজড় ডায়ালেক্‌টিক্‌ মিলে আমাদের দু দিকের কান
টানে ব’লে বেঁচে থাকি—ত্রিবেদীকে বেশি জোরে দিয়েছিল টান।

    (মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থ)
পিরামিড
Friday, May 18, 2018, 9:40 AM

বেলা বয়ে যায়
গোধূলির মেঘ-সীমানায়
ধূম্র মৌন সাঁঝে
নিত্য নব দিবসের মৃতু্যঘন্টা বাজে!
শতাব্দীর শবদেহে শ্মশানের ভষ্মবহ্নি জ্বলে!
পান্থ ম্লান চিতার কবলে
একে একে ডুবে যায় দেশ, জাতি,--সংসার, সমাজ,
কার লাগি হে সমাধি, তুমি একা বসে আছ আজ
কী এক বিক্ষুব্ধ প্রেতকায়ার মতন
অতীতের শোভাযাত্রা কোথায় কখন
চকিতে মিলায়ে গেছে-পাও নাই টের!
কোন দিবা অবসানে গৌরবের লক্ষ মুসাফের
দেউটি নিভায়ে গেছে,---চলে গেছে দেউল ত্যজিয়া,
চলে গেছে প্রিয়তম,---চলে গেছে প্রিয়া!
যুগান্ত্মের মণিময় গেহবাস ছাড়ি
চকিতে চলিয়া গেছে বাসনা-পসারী,
কবে কোন্ বেলাশেষে হায়
দূর অস্ত্মশেখরের গায়!
তোমারে যায়নি তারা শেষ অভিনন্দনের অর্ঘ্য সমর্পিয়া;
সাঁজের নীহারনীল সমুদ্য মথিয়া
মরমে পশেনি তব তাহাদের বিদায়ের বাণী!
তোরণে আসেনি তব লক্ষ লক্ষ মরণ-সন্ধানী
অশ্রু-ছলছল চোখে,---পাণ|ডুর বদনে!
---কুষ্ঞ যবনিকা করেব ফেলে তারা গেল দূর দ্বারে বাতায়নে
জানো নাই তুমি!
জানে না তো মিশরেরর মূক মরুভূমি
তাদের সন্ধান!
হে নির্বাক পিরামিড,---অতীতের স্ত্মব্ধ প্রেত-প্রাণ
অবিচল স্মৃতির মন্দির!
আকাশের পানে চেয়ে আজো তুমি বসে আছো স্থির!
নিষ্পলক যুগ্মভুরু তুলে
চেয়ে আছো অনাগত উদধির কূলে
মেঘ-রক্ত ময়ূখের পানে!
জ্বলিয়া যেতেছে নত্যি নিশি-অবসানে
নূতন ভাস্কার!
বেজে ওঠে অনাহত মেম্ননের স্বর
নিবেদিন অরুণের সনে
কোন্ আশা-দূরাশার ক্ষণস্থায়ী অঙ্গুলি-তাড়নে!
--পিরামিড-পাষাণের মর্ম ঘেরি নেচে যায় দুদণ্ডের
রুধির-ফোয়ারা
কি এক প্রগল্ভ উষ্ঞ উল্লাসের সাড়া!
থেমে যায় পান্থবীণা মুহূর্তে কখন!
শতাব্দীর বিরহীর মন
নিটল নিথর
সন্ত্মরি ফিরিয়া মনে গগনের রক্ত-পীত সাগরের পরে!
বালুকার স্ফীত পারাবারে
লোল মৃগতৃষ্ঞিকার দ্বারে
মিশরের অপহৃত অন্ত্মরের লাগি
মৌন ভিক্ষা মাগি!---
--খুলে যাবে কবে রুদ্ধ মায়ার দুয়ার!
মুখরিত প্রাণের সঞ্চার
ধ্বনিত হইবে করেব কলহীন নীলার বেলায়!---
--বিচ্ছেদের নিশি জেগে আজো তাই বসে আছে
পিরামিড হায়!
-- কত আগন্তুক-কাল,---অতিথি--সভ্যতা
তোমার দুয়ারে এসে কয়ে যায় অসম্বৃত অন্ত্মরের কথা!
তুলে যায় উচ্ছৃঙ্খল রুদ্র কোলাহল!
--তুমি রহ নিরুত্তর,---নির্বেদী,---নিশ্চল!
মৌন, অন্যমনা!
---প্রিয়ার বক্ষের পরের বসি একা নীরবে করিছ তুমি
শবের সাধনা
হে প্রেমিক---স্বতন্হত্র স্বরাট!
---কবে সুপ্ত উত্‌সবের স্ত্মব্ধ ভাঙা হাট
উঠিবে জাগিয়া!
সস্মিত নয়ন তুলি কবে তব প্রিয়া
আঁকিবে চুম্বন তব স্বেদ-কৃষ্ঞ, পাণ|ডু, চূর্ণ,
ব্যথিত কপোলে!
মিশর-অলিন্দে কবে গরিমার দীপ যাবে জ্বলে!
বসে আছো অশ্রুহীন স্পন্দহীন তাই!
---ওলটিপালটি যুগ-যুগন্ত্মের শ্মশানের ছাই
জাগিয়া রয়েছে তব প্রেত-আঁখি,--,প্রেমের প্রহরা!
---মোদের জীবনে যবে জাগে পাতা-ঝরা
হেমন্ত্মের বিদায়-কুহেলি,
অরুন্তুদ আঁখি দুটি মেলি
গড়ি মোরা স্মৃতির শ্মশান
দুদিনের তরে শুধু,---নবোত্‌ফুল্লা মাধবীর গান
মোদের ভুলায়ে নেয় বিচিত্র আকাশে
নিমেষে চকিতে!
---অতীতের হিমগর্ভ কবরের পাশে
ভুলে যাই দুই ফোঁটা অশ্রু ঢেলে দিতে!

    (ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থ)
-----------------------------------
মিতাভাষণ
Thursday, May 17, 2018, 7:17 PM

তোমার সৌন্দর্য নারি, অতীতের দানের মতন।
মধ্যসাগরের কালো তরঙ্গের থেকে
ধর্মাশোকের স্পষ্ট আহ্বানের মতো
আমাদের নিয়ে যায় ডেকে
শান্তির সঙ্ঘের দিকে — ধর্মে — নির্বাণে,
তোমার মুখের স্নিগ্ধ প্রতিভার পানে।
অনেক সমুদ্র ঘুরে ক্ষয়ে অন্ধকারে,
দেখেছি মণিকা-আলো হাতে নিয়ে তুমি
সময়ের শতকের মৃত্যু হলে তবু
দাঁড়িয়ে রয়েছে শ্রেয়তর বেলাভূমি:
যা হয়েছে যা হতেছে এখুনি যা হবে
তার স্নিগ্ধ মানতীসৌরভে।
মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা;
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সঙ্কল্প-স্বপ্নের
উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।
তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল,সূর্য মানে আলো;
এখনো নারী মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।
ভিখিরী
Friday, May 18, 2018, 10:38 AM

একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি আহিরীটোলায়,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি বাদুড়বাগানে,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো–
তবে আমি হেঁটে চ’লে যাবো মানে মানে।
–ব’লে সে বাড়ায়ে দিলো অন্ধকারে হাত।
আগাগোড়া শরীরটা নিয়ে এক কানা যেন বুনে যেতে চেয়েছিলো তাঁত;
তবুও তা নুলো শাঁখারীর হাতে হয়েছে করাত।
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি মাঠকোটা ঘুরে,
একটি পয়সা আমি পেয়ে গেছি পাথুরিয়াঘাটা,
একটি পয়সা যদি পাওয়া যায় আরো
তাহলে ঢেঁকির চাল হবে কলে ছাঁটা।
বলে সে বাড়ায়ে দিলো গ্যাসলাইটে মুখ।
ভিড়ের ভিতরে তবু — হ্যারিসন রোডে —আরো গভীর অসুখ,
এক পৃথিবীর ভুল; ভিখিরীর ভুলে : এক পৃথিবীর ভুলচুক।
নির্জন সাক্ষর
Thursday, May 17, 2018, 9:52 PM

তুমি তা জানো না কিছু—না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে;
যখন ঝরিয়া যাবো হেমন্তের ঝড়ে’—
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে;
আমি ঝ’রে যাবো–তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে,
—আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।

রয়েছি সবুজ মাঠে—ঘাসে—
আকাশ ছডায়ে অাছে নীল হ’য়ে আকাশে-আকাশে;
জীবনের রং তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে’;—সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা—আকাশেও নাই তার স্থল,
চেনে নাই তারে ওই সমুদ্রের জল;
রাতে-রাতে হেঁটে-হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই; কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে-জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে

নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দ আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে।

একবার কথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা
বোবা হয়ে পড়ে থাকে—ভুলে যায় কথা;
যে-আগুন উঠেছিলো তাদের চোখের তলে জ্ব'লে
নিভে যায়—ডুবে যায়—তারা যায় স্খ’লে।
নতুন আকাঙ্ক্ষা আসে—চ’লে আসে নতুন সময়—
পুরানো সে-নক্ষত্রের দিন শেষ হয়
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে;
আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে
কোনো এক মানুষীর তরে
যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হয়ে তার বুকের উপরে।
আমি সেই পুরোহিত—সেই পুরোহিত।
যে-নক্ষত্র ম’রে যায়, তাহার বুকের শীত
লাগিতেছে আমার শরীরে—
যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে
তুমি আছো জেগে—
যে-আকাশ জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে
জেগে আছো;
জানিয়াছো তুমি এক নিশ্চয়তা—হয়েছো নিশ্চয়।
হ’য়ে যায় আকাশের তলে কতো আলো—কতো আগুনের ক্ষয়;
কতোবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত—
তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত
যে-নক্ষত্র ঝ’রে যায় তার।
যে-পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস—আকাশ তোমার।
জীবনের স্বাদ ল’য়ে জেগে আছো, তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে
পারো তুমি;
তোমার আকাশে তুমি উষ্ণ হ’য়ে আছো—তবু—
বাহিরের আকাশের শীতে

নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝ’রে—
ক্লান্ত হ’য়ে—শিশিরের মতো শব্দ ক’রে।
জানোনাকো তুমি তার স্বাদ—
তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,
জীবন অগাধ।

হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ’পরে শুয়ে রবে? অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার।
তোমার আকাশ—আলো—জীবনের ধার
ক্ষ’য়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে।
আমি চ’লে যাবো—তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধ’রে সেইদিন পৃথিবীর ’পরে;
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে।
----------------------------------

পৃথিবীতে
Thursday, May 17, 2018, 8:54 PM

শস্যের ভিতরে রৌদ্রে পৃথিবীর সকালবেলায়
কোনো এক কবি ব’সে আছে;
অথবা সে কারাগারে ক্যাম্পে অন্ধকারে;
তবুও সে প্রীত অবহিত হ’য়ে আছে।

এই পৃথিবীর রোদে-এখানে রাত্রির গন্ধে-নক্ষত্রের তরে।
তাই সে এখানকার ক্লান্ত মানবীয় পরিবেশ
সুস্থ ক’রে নিতে চায় পরিচ্ছন্ন মানুষের মতো,
সব ভবিতব্যতার অন্ধকারে দেশ

মিশে গেল;জীবনকে সকলের তরে ভালো ক’রে
পেতে হ’লে এই অবসন্ন স্নান পৃথিবীর মতো
অম্লান ,অক্লান্ত হ’য়ে বেঁচে থাকা চাই।
একদিন স্বর্গে যেতে হ’তো।
কোনো এক ব্যথিতাকে
Friday, May 18, 2018, 10:47 AM

এখন অনেক রাতে বিছানা পেয়েছ।
নরম আঁধার ঘর
শান্তি নিস্তব্ধতা;
এখন ভেবো না কোনো কথা
এখন শোনো না কোনো স্বর
রক্তাক্ত হৃদয় মুছে
ঘুমের ভিতর
রজনীগন্ধার মতো মুদে থাকো।
তোমাকে (অপ্রকাশিত)
Thursday, May 17, 2018, 11:46 PM

একদিন মনে হতো জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা–
অথবা দুপুরবেলা — বিকেলের আসন্ন আলোয়–
চেয়ে আছে — চলে যায় — জলের প্রতিভা।

মনে হতো তীরের উপরে বসে থেকে।
আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল
কেউ কেউ তুলে নিয়ে চলে গেলে — নীচে
তোমার মুখের মতন অবিকল।

নির্জন জলের রঙ তাকায়ে রয়েছে;
স্থানান্তরিত হয়ে দিবসের আলোর ভিতরে
নিজের মুখের ঠান্ডা জলরেখা নিয়ে
পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;

এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হয়ে গেছে জেনে
এক পৃথিবীর আলো সব দিকে নিভে যায় বলে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয়;
অপরাহ্ণে আকাশের রং ফিকে হলে।

তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;
তোমার বুকের ‘পরে আমাদের বিকেলের রক্তিল বিন্যাস;
তোমার বুকের ‘পরে আমাদের পৃথিবীর রাত;
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।



Comments

Popular posts from this blog

সৈয়দ শামসুল হক-এর কবিতা

সুকান্ত ভট্টাচার্য-এর কবিতা